দুর্নীতি যারা করে, ওদের আবার নীতি থাকে নাকি! কারো কারো থেকে যায়। সত্যি বললে, আমি এই জীবনে যত দুর্নীতিবাজকে দেখেছি এদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু নীতি আছে।
অনেক বছর আগে রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। এক বিয়েবাড়িতে অদ্ভুতভাবে পরিচয়। মফস্বলের বিয়ে-শাদিতে যা হয়, বড় আত্মীয়-স্বজন দূরসম্পর্কের হলেও খুব খাতির করে আনা হয়। ইনিও খুব খাতির পাচ্ছিলেন। রোস্ট দেওয়া হলো দুটি। রেজালার বাটিটা সারাক্ষণ তার সামনে থাকল। তখন আমিও লাইনে ওঠার ধান্দায় আছি, বিয়ে-শাদি বা সামাজিক অনুষ্ঠানে যাই-ই গণ্যমান্য মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আশায়। সুযোগটা মিলল অনেক অপেক্ষার পর। বাড়িতে ভিড়ের তুলনায় বাথরুম একটা বলে লম্বা লাইন। সেই লাইনে ভদ্রলোক ঠিক আমার পেছনে। আমি সুযোগ হারালাম না। সরে গিয়ে ওকে সামনে যেতে দিলাম। এ বিষয়ক একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে বলে জানি বাথরুমের লাইনে কাউকে আগে যেতে দেওয়া কখনো কখনো ম্যাজিকের কাজ করে। করল। ভদ্রলোকের প্রয়োজনটা খুব তীব্র ছিল বলেই বোধ হয় বেরিয়ে কৃতজ্ঞতা দেখাতে আমাকে খুঁজতে থাকলেন। বললাম না, আমি লাইন-তদবিরের লাইনে বেশ পাকা লোক। বাথরুমজনিত উপকারের প্রতিদান পেতে কাছেই ছিলাম।
ভদ্রলোক নাম-পরিচয়ের দিকে না গিয়ে বললেন, ‘খেয়াল করেছেন রোস্টটা একটু শক্ত। পাকিস্তানি কক গছিয়ে দিয়েছে।’
‘তাইতো। আমারও সে রকমই মনে হচ্ছিল।’
‘রেজালার মধ্যেও একটা অপকর্ম করেছে বলে আমার ধারণা। এরা সাবান পানির মতো একটা জিনিস মিশিয়ে দেয়।’
‘বলেন কী?’
‘হ্যাঁ। যাতে আপনার দেখতে খুব ভালো লাগবে। কিন্তু ঠিক হজম করতে কষ্ট হবে। বেশি চলবে না। এমনিতে কেজিতে ছয়জন হিসাব; কিন্তু ওটা দিলে ১০ জন পর্যন্ত চালিয়ে দেওয়া যায়।’
ভদ্রলোকের গভীর পর্যবেক্ষণে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। প্রকাশ করলাম আরো বেশি। বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাই, ‘এই যে দুর্নীতি সমাজের এই স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গেছে, এই বিষয়ে আপনার কী মত?’
‘দুর্নীতির বিস্তারে সমস্যা নেই। দুর্নীতি অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখে।’
‘তাহলে দুর্নীতি করে যেতে বলছেন?’
‘আমি বললেও মানুষ করবে, না বললেও করবে। এমন যদি হতো যে আমার বলা, না বলার ওপর কিছু নির্ভর করছে, তাহলে ভাবতাম। দুর্নীতি হচ্ছে পৃথিবীর আদি নীতি। দুর্নীতি চলবেই। তবে আমরা যেটা করতে পারি, তা হলো দুর্নীতির ক্ষেত্রে একটা নীতি মেনে চলা।’
‘দুর্নীতির ক্ষেত্রে নীতি! ঠিক বুঝতে পারলাম না যেন।’
‘শুনেন ভাইজান, আমরা সবাই কিন্তু সেটা মেনে চলি।’
‘তা আমার আগেই মনে হয়েছিল আপনি বিচক্ষণ মানুষ। সব কিছুতে একটা নীতি থাকবে আমার।’
‘আমার না, বলুন আমাদের। আমাদের সবারই একটা নীতি আছে। নিজের সব কাজকে আমরা কোনো না কোনোভাবে জাস্টিফাই করি না। যারা অপকর্ম করে ওরাও করে।’
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সঙ্গে বেশ খাতির হয়ে গেল। উঠতে-বসতে তাঁর প্রশংসা করে বেশ কাছের মানুষ হয়ে উঠলাম। যোগ্যদের ডিঙিয়ে তিনি আমাকে দুটি কাজও দিলেন। একটা বেশ বড়। স্থানীয় একটা প্রশাসনিক বিল্ডিং দোতলা হবে। মূল কাঠামো ঠিক রেখে সম্প্রসারণ।
কাজটা দিয়ে কানে কানে বললেন, ‘আমার নীতিটা আপনি জানতে চেয়েছিলেন না? সেটা শুনতে এবং মানতে হবে।’
‘শুনতেই তো অধীর হয়ে আছি।’
‘যাই করেন, কোনো মানুষ যেন মারা না যায়।’
‘মানুষ মরবে কেন?’
‘সেটাই। আপনি যত ইচ্ছা অপকর্ম করতে পারেন; কিন্তু মনে রাখবেন আপনার কারণে যেন কোনো মানুষের মৃত্যু না হয়।’
‘তাহলেই আপনার চলবে।’
‘জি। আমারও চলবে। আপনিও চালিয়ে নিতে পারবেন।’
‘ঠিক বলেছেন মার্ডার কেসটাই এ দেশে সামাল দেওয়া মুশকিল। আর সব সামাল দেওয়া যায়।’
‘এইতো গাড়লের মতো কথা বলছেন। আমি কেসের কথা বলছি না। আমি বলছি নীতির কথা। আজকাল নারী নির্যাতন মামলা মার্ডারের চেয়ে কঠিন। পরকীয়া প্রেম সামাল দেওয়াও চাট্টিখানি কথা নয়। নীতি হচ্ছে মামলা-মোকদ্দমা না ভেবে বিবেকের কথা ভাবা।’
ওর সঙ্গে তাল দিয়ে অনেক কাজ পেলাম। আয়-উন্নতি হলো প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি। টাকা হলে যা হয়, নাম করতে ইচ্ছা করে। খেয়াল করে দেখলাম, কন্ট্রাক্টরি বা ব্যবসায় যত পয়সাই হোক শেষ পর্যন্ত একরকম মোসাহেবির জীবন। একে-ওকে খুশি করতে হয়।
ঠিক করলাম ক্ষমতা লাগবে। ক্ষমতায় যাওয়ার উপায় রাজনীতি। টাকা হলেই রাজনীতি খুব সহজ জানতাম; কিন্তু এতটা যে সহজ কল্পনাও করিনি। টাকা ছড়ালাম আর সবাই পায়ের কাছে লুটাতে থাকল। সরকারি দলের এক চ্যাংড়া গোছের নেতা খুব তেড়িবেড়ি করছিল। প্রকাশ্য জনসভায় যা-তা বলল। যার সব মিথ্যা নয়। জেলা পরিষদের একটা কাজে আমার করা বিল্ডিংয়ে যে কয়েক মাসের মধ্যে ফাটল ধরেছিল এবং পরে যে স্থানীয় সরকার বিভাগের তদন্তে সিমেন্টের সঙ্গে মাটি মেশানোর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল। আমি একটু ভড়কে গেলাম।
সহকারী রঞ্জন বলল, ‘স্যার রেট বাড়াচ্ছে।’
‘সত্যি কি ওর রেট আছে?’
‘সবার আছে। ওকে একটু বেশি দিতে হবে।’
তবু বিশ্বাস করিনি। কিন্তু রাতের বেলা শহরের নামকরা হোটেলে বিদেশি মদের বোতল খুলতে খুলতে চ্যাংড়া নেতাটি সরাসরি বলল, ‘মাসে দুই লাখ করে দিতে হবে।’
‘যদি না দিই?’ আমিও সরাসরি।
‘পরে পাঁচ লাখ দিতে হবে।’
‘কেন?’
‘পরের বক্তৃতায় আরো কিছু বেরোবে, যা আপনার মনে নেই। একটু হিন্টস দিই। কলেজে থাকার সময় শিবানী বলে একটা হিন্দু মেয়ে ছিল…’
এরপর আর শোনার দরকার দেখলাম না। দুই লাখেই রফা হয়ে গেল।
চ্যাংড়া নেতাটি বলল, ‘আপনার উন্নতি হবে। রাজনীতিতে সবচেয়ে দরকার হচ্ছে টাকা ছাড়ার হার্ট।’
তখনো রাজনীতি অতটা শিখিনি বলে প্রশ্ন করলাম, ‘এভাবে ছাড়লে তো টাকা শেষ হতে কয়েক রাতও লাগবে না।’
‘এই শেষ হওয়ার ভয়ে টাকা রোজগারের পথ বের করতে মরিয়া হবেন।’
‘উপায় চাইলেই বের করা যাবে?’
‘ব্যবসায়ীরা পারে।’
তারপর হেসে দিয়ে বলে, ‘ব্যবসায়ীদের আমরা রাজনীতিকরা এমন স্বাগত জানাই কেন জানেন?’
‘টাকা খাওয়ার জন্য।’
‘সেটা তো আপনাকে বাইরে রেখেই খাওয়া যায়। কিন্তু রাজনীতিতে আসলে সুবিধা হলো, এরা রোজগারের নতুন পথ বের করতে পারে। আমরা সেই পথগুলো দেখি; কিন্তু কাজে লাগাতে পারি না। এরা পারে। ফলে দুপক্ষেরই লাভ।’
‘রাজনীতিকরা এত কিছু পারে আর এই জিনিসটা পারে না?’
‘ব্যবসায়ীরা জানে, কখন হাত ধরতে হয় আর কখন হাত চালাতে হয়। রাজনীতিকরা হাত তুলতে জানে; কিন্তু হাত-পা ধরার কায়দাটা খুব ভালো জানে না। ক্ষমতার অহংকারেই মনে হয়।’
ওর সঙ্গে পুরো একমত হইনি। কিন্তু এই একটা ব্যাপার আমি আমার মধ্যে দেখেছি, কারো কোনো কথাই আমি ফেলি না। ফলে কোনো না কোনো সময় কাজে লেগে যায়।
ওর কথাটা খুব কাজে লাগল। টাকার জোরে ক্ষমতাবান হয়ে গেলাম। আবার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে টাকার পাহাড়ে চড়ে বসলাম।
কিন্তু সঙ্গে নীতিও আছে। ওই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের কথাটা। দুর্নীতি করব কিন্তু মানুষের প্রাণ যাবে—এমন কিছুতে আমি নেই।
এই নীতি মানতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল না। কিন্তু সমস্যায় পড়লাম একবার। আমি তখন পৌরসভা চেয়ারম্যান, পৌর হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহের একটা কাজ আছে, সংসদ সদস্য কাজটা নিজের লোককে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। ওর কোনো অনুরোধই ফেলি না। মাত্রই আগের মাসে, ভূমিহীনদের খাসজমি বিতরণে আমার দলের ক্যাডারদের আত্মীয়-স্বজনকে শতকরা ৫০ ভাগ ভুয়া নামে দিয়ে দিয়েছি। এর আগে অতিদরিদ্রদের জন্য মঞ্জুরি এলো। এবারও অর্ধেকের বেশি দিলাম সংসদ সদস্যদের লোকজনকে। ওগুলোতে নিজের লাভ খুব বেশি ছিল না। এটাতে অনেক বড় লাভ। এমপি সাহেব ফোন করে সেটাই বললেন, ‘শোনো, তুমি কয়েকটা বড় কাজ করে দিয়েছ। কিন্তু তোমাকে কিছু দিতে পারিনি।’
‘লাগবে না। আশীর্বাদ দেবেন। আপনার হাতটা মাথায় আছে বলেই না করে খাচ্ছি।’ তত দিনে আমি রাজনীতিটা খুব ভালো শিখে গেছি।
‘হাতফাত বহুজনের মাথায় রেখে দেখেছি, কায়দামতো লোকে খোঁচা মেরে দেয়। আমি হাতফাতে আর বিশ্বাসী না। বিশ্বাসী কাজে।
‘বলেন স্যার, আপনার কী সেবা করতে পারি?’
‘ওই হাসপাতালের কাজটা উমর আলীকে দিয়ে দাও।’
‘উমর আলী!’ একটু ভেবে বললাম, ‘কিন্তু স্যার, ওর রেকর্ডটা তো ভালো না। আগেও অভিযোগ আছে।’
‘আরে পাগল, অভিযোগ থাকাতেই না সুবিধা। বিলের ২০ পার্সেন্ট পর্যন্ত দেবে। বুঝতে পারছ তো, ২০ পার্সেন্ট মানে… আধাআধি ভাগ করলেই তো দুজনের পকেটে কোটির বেশি টাকা ঢুকবে।’
আমি চুপ করে থাকি।
এমপি সাহেব হুমকির মতো করে বলেন, ‘চাইলে আমি মিনিস্ট্রি থেকেই ওকে কাজটা পাইয়ে দিতে পারতাম; কিন্তু মনে হলো তোমার জন্য কিছু করা হয় না। ওই যে খাসজমিতে তুমি অর্ধেক আমাদের ছেলেদের দিলে, কিন্তু তোমাকে কিছু দিতে পারলাম না। তাই…। কী বলো?’
‘স্যার, আমি উমর আলীকে কাজটা দিতে পারব না।’
‘কেন, পার্সেন্টেজ বেশি চাও?’
‘না স্যার, ও বাজে লোক।’
‘আরে বোকা, বাজে লোক বলেই তো আমাদের কাছে আসে। ভালো লোক হলে তো সরাসরি কাজ পেয়ে যেত। আমাদের আঙুল দেখাত। কিন্তু তুমি হঠাৎ ধর্মপুত্র, ওই যে কী যেন ব্যাটার নাম…’
‘যুধিষ্ঠির’
‘হ্যাঁ, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির হয়ে গেলে যে? কেস কী?’
‘স্যার, আমি-আপনি আমরা সবাই খারাপ। দুর্নীতি করি কিন্তু এর মধ্যেও আমার একটা নীতি আছে।’
‘তোমার আবার নীতি! বলছ কী?’
‘বেশি না… একটা মাত্র নীতি?’
‘কী নীতি?’
‘মানুষের মৃত্যু হতে পারে এমন কোনো কাজ আমি করব না। উমর আলী হাসপাতালে ভেজাল এবং নিম্নমানের ওষুধ দিয়ে দেবে। মানুষ মারা যেতে পারে।’
এমপি সাহেব মাথা গরম করলেন না। বললেন, ‘ঠিক আছে। নীতিটা খারাপ না। আমিও দেখি এ রকম দু-একটা নীতি মানতে পারি কি না।’
ঠাণ্ডা মাথার মানুষরা কাজও করে ধীরস্থিরে। আর তাই তাতে ফাঁক থাকে না বিশেষ। পরের ১০ দিন তেমন কোনো নড়চড় নেই, একাদশ দিনে মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি এলো। খাসজমি ও দরিদ্রদের জন্য গম বিতরণে অনিয়মের সুস্পষ্ট অভিযোগ। একেবারে প্রমাণসহ সেখানে পৌঁছে গেছে। তদন্ত কমিটিও হয়ে গেছে।
রঞ্জন বলল, ‘স্যার, মাথা ঠাণ্ডা রাখেন। এমপির সঙ্গে সরাসরি লড়াই করে পারা যায় না।’
আমি ঠাণ্ডা মাথায় বললাম, ‘লড়াই করব না। পদত্যাগ করব।’
‘কী করবেন স্যার?’
‘পদত্যাগ!’
‘বলছেন কী?’
‘হ্যাঁ, প্রেস কনফারেন্সের ব্যবস্থা করো। আমি পদত্যাগের ঘোষণা দেব।’
‘কিন্তু স্যার, এমপি সাহেবের প্রসঙ্গে কিছু বলবেন না। বলবেন, ব্যক্তিগত কারণে। স্বাস্থ্যগত কারণ বললে আরো ভালো।’
হেসে বললাম, ‘সবাইকে খবর দাও।’
রাজনীতিকরা বুঝতে পারেন না তাঁদের হাতের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে পদত্যাগ। আমি বুঝতে পেরেছিলাম। তাই পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে আমি পুরো হিরো। কারো বিরুদ্ধে কিছু বলিনি। শুধু বললাম, রাজনীতির এই দলবাজি, নোংরামি দেখে আমি একটু ক্লান্ত। কিছুদিন বিশ্রামে থাকতে চাই।
ম্যাজিকের কাজ হলো। যে আমার বিরুদ্ধে অনেক মানুষ ছিল, অনেক আকথা-কুকথা লোকে বলে বেড়াত, সেই আমার পক্ষে এখন সবাই। সবাই আমার পক্ষে। রঞ্জন অবাক হয়ে বলল, ‘স্যার, আমি তো ভেবেছিলাম ক্যারিয়ার শেষ। নতুন লোকের পেছনে লাইন দিতে হবে।’
হাসলাম।
রঞ্জন বলল, ‘স্যার, আপনি জানতেন? আপনি স্যার অনেক দূর যাবেন। অনেক দূর…’
সত্যিই অনেক দূর এসে গেছি। আমার পক্ষে এমন জনস্রোত তৈরি হলো যে এমপি সাহেবও ঠ্যালায় পড়ে তাঁর অভিযোগপত্রটা উঠিয়ে নিলেন। দুটি প্রকাশ্য সভায় আমাকে দলে ফেরার আবেদন জানালেন। সমাবেশে তখন এত হাততালি পড়ল যে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আমি দলে না ফিরলে তিনি অবস্থান ধর্মঘট করবেন আমার বাড়ির সামনে।’
আমি চুপ থাকলাম। কখনো কখনো চুপ থাকলেই সবচেয়ে বেশি লাভ। চুপ থেকে সময়মতো গর্জন করতে হয়।
করলাম এমপি ইলেকশনে মনোনয়নের সময়। আমাকে না দিয়ে উপায় ছিল না। জিতলাম। রেকর্ড ভোট পেয়ে। এত ব্যবধানে কোনো প্রার্থী কোনো দিন জেতেননি। তা ছাড়া জাতীয় পর্যায়েও আমি আলোচনায়। আমার পদত্যাগের মধ্যে যে ত্যাগের মহিমা তা নিয়ে পলিটিক্যাল কলামিস্টরা অক্লান্তে লিখে যাচ্ছেন।
এমন জনপ্রিয় লোককে মন্ত্রী বানালে দলের ইমেজ উজ্জ্বল হয়। পার্টি থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে, আমি মন্ত্রী হব। প্রথমবার বলে প্রতিমন্ত্রী, তবে দপ্তর দেওয়া হবে পছন্দমতো।
ঠিক এই সময়ের গল্পটা বলার জন্যই এত ভূমিকা করলাম। মন্ত্রী হওয়ার দুই দিন আগে ফেসবুকে একটা ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। আমি বলছি, ‘আমার কোনো দুর্নীতিতে আপত্তি নেই। ঘুষ খাওয়া, টাকা নিয়ে চাকরি দেওয়া, ফান্ড মেরে দেওয়া—সব কিছুতে আছি। কিন্তু মানুষের জান যেতে পারে এমন কোনো কাজে আমি রাজি না।’
রঞ্জন বলল, ‘এমপি, মানে ওই আগের এমপির কাজ। মনোনয়ন না পেয়ে… বলেন তো হাড়-মাংস এক করে কিমা বানাই।’
আমি কিমা বানানোর অনুমোদন দিলাম না।
রঞ্জন আবার বলল, ‘আপনি প্রেস কনফারেন্স করে বলুন সব ভুয়া। বাকিটা আমরা সামলে নেব।’
কিন্তু আমি চুপ করে আছি। সব শুনছি।
পুরো দেশ দুই ভাগ হয়ে গেছে। বিরোধীরা বলছে, এই দলের সবাই এ রকম। একজন ধরা খেয়েছে। বাকিরাও ধরা খাবে।
আমার দল বলছে, সব ষড়যন্ত্র। আমাদের জনপ্রিয়তম নেতাকে অসম্মানের চেষ্টা। মানুষই তো তার রায় দিয়ে দিয়েছে।
আমি কিছু বললাম না। শুনতে থাকলাম। টক শোর বোদ্ধা-বিশ্লেষক, পত্রিকার কলামিস্ট সবার নানা মত। আমার পক্ষেও কেউ কেউ আছে। কেউ বলছে, ‘মানুষটার তো তবু একটা কাজে আপত্তি আছে। বেশির ভাগের তো তাতেও আপত্তি নেই।’
আরেক পক্ষ বলছে, ‘দুর্নীতি মানে দুর্নীতি। ঘুষ খাওয়া-টাকা মারা মানুষকে হত্যারই সমান।’
ঠিক এ রকম আলোচনায় একদিন বিশ্লেষক শ্রেণির একজন বললেন, ‘উনি মানুষের মৃত্যু চান না। খুব ভালো কথা। কিন্তু উনি কী জানেন, উনি যাদের বাঁচিয়ে রাখেন, তার বা তাদের দুর্নীতির কারণে এদের জীবনের কী হাল হয়! কিভাবে বেঁচে থাকে ওরা। উনি মোহাম্মদপুর বস্তি, কমলাপুর রেলস্টেশন অথবা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে রাতের বেলা একবার যদি যান… তাহলে মনে হবে এই বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।’
অদ্ভুত ব্যাপার, আমি সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। এখন গভীর রাতে ঢাকা শহরের বস্তিগুলো দেখতে বেরিয়েছি। ঠিক দেখতে পারছি না। এসব আসলে দেখতে নেই।
মোবাইলটা বের করে ফোন করলাম। ওপাশ থেকে ঘুম ঘুম গলায় কেউ একজন বলল, ‘হ্যালো..’
‘আপনি ঠিকই বলেছেন। এদের বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই ভালো। আমার নীতিতে ওদের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি।’
‘কে বলছেন? ও… আপনি? তাহলে আপনি এখন খুনও অ্যালাউ করবেন? আচ্ছা, আমি কি আপনার এই কথাটা কোট করতে পারি? হ্যালো, শুনছেন…’
ফোনটা রেখে হাঁটতে থাকি। পেছনে নোংরা বস্তি, উলঙ্গ বাচ্চার কান্না, অনাহারী-অর্ধাহারীদের বিশ্রী নাক ডাকা, মহিলাদের অসহনীয় ঝগড়া, মদের আড্ডার কুশ্রী গালাগাল, জুয়ার আসর থেকে আসা খিস্তি।
আমি সামনে হাঁটি। পেছনে তাকাই না। আমাদের ওসব দেখতে নেই।