Golam Kibria

আমার মোস্তফা মামুন পাঠ :: গোলাম কিবরিয়া

মোস্তফা মামুনের সঙ্গে আমার পরিচয় ক্যাডেট কলেজে। কথাটা শুনলে স্বয়ং মামুনেরতো বটেই, আমাকে যারা চেনেন তাদের ভ্রু আকাশে উঠবে, সন্দেহ নেই।
‘কিবরিয়া আবার ক্যাডেট কলেজে পড়লো কবে!’ এ প্রশ্নটা জাগা স্বাভাবিক।
সৈয়দ মুজতবা আলীর ’দেশে বিদেশে’-এর হাত ধরে যেমন ঘুরে এসেছি পেশোয়ারে পাঠানদের আড্ডা থেকে, কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানার সঙ্গে চলে যাই দেশ বিদেশে রোমহর্ষক অ্যাসাইনমেন্টে, কিংবা জাহানারা ইমামের ’একাত্তরের দিনগুলি’ যেভাবে নিয়ে যায় উত্তাল সেই সংগ্রামের দিনগুলোতে, সেভাবেই মামুনের হাত ধরেই ক্যাডেট কলেজের দুরন্তপনা আর দুষ্টুমির জগতটা ঘুরে আসার সুযোগ হয়েছে, সেই জগতের বাসিন্দা না হয়েও।
’ক্যাডেট নাম্বার ৫৯৫’ আমার প্রথম মোস্তফা মামুন পাঠ।
হাঁড়ির চাল যেমন একটা টিপেই বোঝা যায় সবগুলো সেদ্ধ হয়েছে কিনা। না, কোনো লেখকের মাত্র একটি বই পড়েই বোঝা সম্ভব নয়, তার সবগুলো বইয়ের মান একই রকম কিনা, বড়জোর তার লেখার ক্ষমতা সম্পর্কে পাঠক কিছুটা ধারণা পেতে পারেন। এমন অনেক লেখক আছেন, পাঠককে মুগ্ধ করার মত অনেক রচনা যেমন তাদের রয়েছে, তেমনি আছে একেবারে বিপরীতর্মী জঞ্জালও। তবে একটা কথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, লেখক মোস্তফা মামুন অন্তত আমাকে কখনো হতাশ করেননি।
মোস্তফা মামুনের রচনার বড় অংশজুড়ে আছে কিশোর সাহিত্য। এ ছাড়া তার প্রিয় বিষয় ক্রিকেট নিয়ে রয়েছে বেশ কিছু বই, আছে প্রেমের উপন্যাস। মোট কথা সাহিত্যের নানা অঙ্গণে রয়েছে তার সরব উপস্থিতি।
এখন লেখক আমার মতো পাঠকের আগ্রহ তখনই জাগিয়ে তুলতে পারেন, যখন তার লেখনশৈলীতে নিজস্বতার ছাপ রাখতে পারেন। এদিক থেকে মোস্তফা মামুন শতভাগ সফল বলা যায়। তার যে কোন রচনার দুই-একটি প্যারাগ্রাফ পড়ে নিয়মিত পাঠকরা বুঝে যাবেন, এই রচনা কার মস্তিষ্কপ্রসূত! মামুন তার লেখায় এতোটাই স্বকীয়। সেটা হোক কিশোর উপন্যাস, রম্য রচনা, সমকালীন বিষয় নিয়ে লেখা কলাম, পত্রিকার উপ সম্পাদকীয় কিংবা প্রেমের উপন্যাস। সবখানেই পাঠক পাবেন মোস্তফা মামুনের নিজস্বতা, তার ‘সিগনেচার’।
সব শেষ মামুনের যে বইটি পড়ে আমি বরাবরের মতোই মুগ্ধ হয়েছি, সেটি নিয়ে দু কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না।
তীক্ষ্ণ রসবোধ, অসাধারণ গদ্য আর জমজমাট গল্পের ‘ফুল প্যাকেজ’ মোস্তফা মামুনের ‘প্যাকেট নিয়ে পাগলামি’। বইটি শুরু করলে শেষ না করে উঠার পথ পাবেন না, তাই হাতে কিছুটা সময় নিয়ে এটা পড়া শুরু করাই ভালো।

একটি পৌরসভার এক স্কুল শিক্ষককে নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত, যিনি আকষ্মিকভাবেই নিজেকে মৃত ভাবতে শুরু করেন। তাকে অবশ্য এ জন্য দোষ দেয়া যায় না, কারণ ঘটনার পেছনে মূল দায় পৌর কমিশনার জলিল মন্ডলের। কমিশনার সাহেব একটি কুলখানিতে দেওয়ার জন্য মুখস্ত করে রাখা বক্তৃতা স্কুল শিক্ষকের বিদায় অনুষ্ঠানে আউড়ে যান, অবশ্যই ভুল করে। আর এ থেকেই বিপত্তির শুরু। গল্পের এক একটি পর্যায়ে আরো কিছু চরিত্রের আবির্ভার ঘটে, যেমন পেশায় অসফল চোর নেসার, স্কুলের আরো কয়েকজন শিক্ষক এবং সর্বোপরি ‘কভু’।

গল্পচ্ছলে যে গভীর বার্তা দিয়েছেন লেখক, তাতে চমকে উঠতে হয়।

১১২ পৃষ্ঠার সীমিত পরিসরের এই উপন্যাসিকাটিতে একাধারে আমাদের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতার অপব্যাবহার-দুর্নীতি, শিক্ষাঙ্গনের অসুস্থ্য রাজনীতি, মানুষের সীমাহীন লোভ এবং সমাজের নানা অসঙ্গতির ছবি আঁকা হয়েছে অনায়াস দক্ষতায়। আর এখানেই মামুনের কৃতিত্ব। উপদেশমূলক গল্পের মতো এই গল্পের পরতে পরতে উপদেশবাণী প্রোথিত নেই, কিন্তু রয়েছে চিন্তার খোড়াক, ভাবনা উদ্রেগকারী উপাদান। বইটি নিঃসন্দেহে ছেলে-বুড়ো সবার ভালো লাগবে, তবে এর রস একেক বয়সের পাঠক আস্বাদন করবেন ভিন্ন ভিন্ন পন্থায়।

এবারের বইমেলার মাঠে কয়েকজন লেখক আর প্রকাশকের আড্ডায় সমকালীন সাহিত্যিকদের নিয়ে কথা হচ্ছিল। প্রসঙ্গক্রমে মামুনের কথাও উঠে (তিনি নিজে অবশ্য সেই আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন না, আর ছিলেননা বলেই তাকে নিয়ে নিমোহ আলোচনা জমে উঠেছিল।) সেখানে আমি বলেছিলাম, এই সময় সাহিত্যর্চা করছেন, এমন সাহিত্যিকদের মধ্যে সবচেয়ে আন্ডাররেটেড হচ্ছে মোস্তফা মামুন। অন্যরাও আমার কথায় সায় দিয়েছিলেন।
এমনটা কেন? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমার জানা নেই। তবে একটা কথা হলফ করেই বলা যায়, বর্তমান সময়ে যেখানে সব জয়গাতেই নিজেকে ‘তুলে ধরার’ একটা প্রবল প্রবণতা, সেখানে মামুনের মতো মৃদুভাষী আর বিনয়ীদের পাঠকের মন জয় করতে ভরসা শুধু নিজের কলমে। মামুন অন্তত সেটা করে দেখাচ্ছেন।
এতো গেল একজন পাঠকের চোখে লেখক মোস্তফা মামুনের , এবার তার সম্পর্ কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতেই হয়।
তার সাথে পরিচয় ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। লেখক মামুনের গুণমুগ্ধ পাঠক আমি, আর ব্যক্তি মামুনের ফ্যান। মামুন এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যখন কোন আসরে সে কথা বলে, বাকিরা শ্রোতা বনে যেতে বাধ্য হয়। আবার ক্রিকেটের কোন বিষয় নিয়ে যখন একের পর এক পরিসংখ্যান মুখস্ত বলে যেতে থাকে, তখন তাকে গুরু না মেনে উপায় থাকে না।
এই সুযোগে কথাটা স্বীকার করে ফেলি, মামুনের এমন ঝড়ো ব্যাটিংয়ের ফাঁকে দুই একবার তার অগোচরে ক্রিকেটিয় পরিসংখ্যানের সত্যতা যাচাই করে নিয়েছি, আশ্চর্ , কখনোই ভুল পাইনি! বন্ধু হিসেবে মামুনকে পাওয়া একটি বিরল সৌভাগ্য। আমার সেই সৌভাগ্য হয়েছে।
মামুনের জন্য শুভ কামনা, আরো বহু বছর তার সাহিত্যসূধা উপভোগ করতে চাই। শতফুল ফুটুক মামুনের কলমে, আর আমরা মোহিত হবো সেই বৈচিত্রময় লেখনশৈলীতে।

Leave Comment