Dhruba Esh pic

‘কলেজ ক্যাপ্টেন’ বইয়ের লেখক :: ধ্রুব এষ

আমি এক মোস্তফা মামুনকে চিনি, ফিকশন লেখে। আরেক মোস্তফা মামুনকে চিনি, ফ্যাক্ট লেখে। প্যারাডক্স। এই দুই মোস্তফা মামুন একজন হয়েও দুজন। যে ফিকশন লেখে সে লেখক, যে ফ্যাক্ট লেখে সে সাংবাদিক। মেধাবী এবং বিখ্যাত সাংবাদিক। আমাদের দেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতার ভাষা যারা অধিকতর সৃষ্টিশীল এবং সমকালীন করেছেন, তাদের একজন। কিন্তু তার কথা এখানে এত বলার অবকাশ নেই। এই লেখা আরেক মোস্তফা মামুনকে নিয়ে। সে ফিকশন লেখক মোস্তফা মামুন।
বড়দের গল্প উপন্যাস কিছু লিখলেও মূলত কিশোর পাঠকদের লেখক, প্রিয় লেখক মোস্তফা মামুন। কিশোরদের জন্য লিখে জনপ্রিয় হয়েছে। কিশোর কারা? আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত যদি শিশু হয়? মানানসই ইংরেজদের টিনএজের হিসাব সে ক্ষেত্রে। থারটিন থেকে নাইনটিন। তেরো থেকে উনিশ। এরা মোস্তফা মামুনের পাঠক। এদের জন্য চমৎকার কিছু গল্প উপন্যাস লিখেছে মোস্তফা মামুন। ‘তনু কাকা সিরিজ’ লিখেছে। লিখে যাচ্ছে। লিখে যাক। দেশের গল্প দশের গল্প এভাবে লিখে যাক। রোয়াল্ড ডাল, এনিড ব্লাইটন ঝাড়া জিনিস না। আমাদের দেশের কিছু কিশোর সাহিত্যকাক (!) যেখানে এই কাজকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন দেখি। নিষ্ঠার সঙ্গে চালাচ্ছেন। নিপাত যাক সেইসব পরজীবীরা। লেখক মোস্তফা মামুন পরজীবী না।
তেরো থেকে উনিশ বললাম মোস্তফা মামুনের পাঠক, আমি পড়ি কোন ক্যাটাগরিতে?
তেরো ওল্টালে ঢের কম হয়ে যাবে, উনিশ ওল্টালে ঢের বেশি হয়ে যাবে। ব্যাপার না। আমি কেন মোস্তফা মামুনের বই পড়ি বলি। প্রচ্ছদ বানিয়ে দিতে হয় বলে? এটা একটা কারণ, তবে গৌণ। মুখ্য কারণ হলো ভালো লাগে পড়তে। সেই কবে তার ‘কলেজ ক্যাপ্টেন’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সবসময়ই (!) কিশোর সাহিত্যের আমি একজন মনোযোগী পাঠক। বই পড়ি কোন কাল থেকে বলতে পারব না। কাজী আনোয়ার হোসেনের সেবা প্রকাশনী রহস্যময় বর্মী বাক্স ছিল আমাদের। নানা রকম বইয়ের রাজ্যপাট। সারা পৃথিবীর ক্লাসিক বইগুলো সেবা আমাদের পড়িয়েছে বাংলায়। তার সঙ্গে ছিল রাশিয়ার বই। প্রাভদা ও রাদুগা প্রকাশনের। আর যত বই, খগেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘ভোম্বল সর্দার’ থেকে মাহমুদুল হকের ‘চিক্কোর কাবুক’ (‘কুশল ও চিক্কোর মারণকাবুক’ নামে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল), আমি একা না, আমাদের সময়ের অধিকাংশ স্কুল গোয়িং ছেলেই পড়েছে। উনিশশ সত্তর আশির দশকের মফস্বলের কথা বলছি। আউট বই খুব পড়ত ছেলেরা মেয়েরা। স্কুলের স্যার, বাবা, চাচাকে লুকিয়ে। ধরা পড়ে প্রহৃতও হতো অনেকেই। সে স্মৃতি এখন মধুর। শর্ষেফুল, কার্পাস তুলার দিনে টেনে নিয়ে যায়।
বয়স হয়ে গেছে আমাদের। রোজই সকলের বয়স হয়ে যায়। আমার স্কুলজীবনের বন্ধুদের মধ্যে এখনো বই পড়ে দুজন, মোবাইল ফোনে কম সময় দিয়ে। তারা হলো মান্না এবং অঞ্জন। একজন অধ্যাপক, একজন ভিন্ন পেশাজীবী। পুরনো বই, নতুন বই নিয়ে কথাবার্তা হয় আমাদের। ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র এক ঈদ সংখ্যায় প্রথম ছাপা হয়েছিল ‘কলেজ ক্যাপ্টেন’। পড়ে আমি মুগ্ধ। পড়ে মান্না মুগ্ধ। সেই ঈদ সংখ্যা ‘বিচিত্রা’ আমি মান্নার জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম। অঞ্জনের সঙ্গে তখন আমার শত্রুতা চলছিল কি না মনে নাই, ‘বিচিত্রা’ ঈদ সংখ্যা তাকে মান্নাও দেয়নি।
‘কলেজ ক্যাপ্টেন’ বই প্রকাশিত হয় ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে। অমর একুশে বইমেলায়। প্রকাশক অনন্যা। আমার বন্ধু মুস্তাফার ফটোগ্রাফি দিয়ে বানানো প্রচ্ছদমাঠে জনি এবং সুজন, ‘কলেজ ক্যাপ্টেন’-এর দুই চরিত্র। গল্পটা পালা করে বলে এই দুজনই। এক অধ্যায় জনি, এক অধ্যায় সুজন। কিভাবে তারা তাদের পারিপার্শ্বিক দেখছে? তারা পড়ে ক্যাডেট কলেজে, কঠিন নিয়ম-কানুনে আটকা, ন্যায্য বদমায়েশি করতেও মাপতে হয়।
ক্যাডেট কলেজে ভুলভাল ইংরেজি বললেও হয়, কিন্তু না বললে নয়। জনি উবাচ।
মহত্ত্বে কারো কাছে পরাজয়ই হলো সত্যিকার পরাজয়। সুজন উবাচ।
গল্প এই দুজন এবং ক্যাডেট লাইফ নিয়ে। সাধারণের খুব চেনা জগৎ না। চেনা হয়ে যায় ৮০ পৃষ্ঠায়। কলেজ ক্যাপ্টেন ৮০ পৃষ্ঠার বই। ষোলো আনা দেশি ক্যাডেটদের গল্প। হাতের কাছে পেয়ে আবার বহুদিন পর পড়লাম। মুগ্ধতা কাটেনি। কোভিড-১৯ অধ্যুষিত একটা শীত শীত দুপুর ক্যাডেটদের সঙ্গে থাকলাম। চমৎকার!
আমরা ‘বটলা’ বলি ‘মোটা’কে। আমাদের অঞ্চলে। অঞ্জন হলো বটলা অঞ্জন। কল দিলাম। কাল সকালেই কুরিয়ারে পাঠাচ্ছি।
‘কলেজ ক্যাপ্টেন বইটা পড় রে বটলা।’
‘কলেজ ক্যাপ্টেন! কার লেখা বই?’
‘মোস্তফা মামুন।’
‘অ, আইচ্ছা। পড়মু নে।’
‘পইড়া কী রকম লাগল জানাইস।’
‘জানাইসে’ অঞ্জন।
‘এই, মোস্তফা মামুন ছেলেটা কে রে? চমৎকার লিখছে তো। এ কি ক্রীড়া সাংবাদিক মোস্তফা মামুন?’
‘না। এ লেখক মোস্তফা মামুন।’
‘কলেজ ক্যাপ্টেনের’ ভাষা মায়াময়। শান্ত নদীটি পটে আঁকা ছবিটি-র ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো। রোদে ঝিলমিল। উইট তীক্ষ্ণ। সারল্য স্মৃতিকাতর করে।
আফসোস! মোস্তফা মামুনের এই দারুণ বইটা নিয়ে কোনো আলোচনা আমি পড়িনি। কেউ লিখেছেন কি না জানি না। লেখা দরকার। বিজ্ঞাপনের গোরু ছাগল কাক লেখকের বড় উৎপাত এখন। উদ্দেশ্যমূলক বই আলোচনা প্রচুর ছাপা পত্র পত্রিকায়। বিকট এই পরিস্থিতিতে ভালো বই কোনটা, চিহ্নিত করতে পারেন কেবল ভালো পাঠকরাই। সেইসব ভালো পাঠকরা ভালো বই নিয়ে বললে লিখলে, অফলাইনে কি অনলাইনে, উপকার দেখি, অপকার দেখি না।
সদ্য আবার পড়া বলেই হয়তো, এতক্ষণ ধরে শুধু মোস্তফা মামুনের ‘কলেজ ক্যাপ্টেন’ বইয়ের কথাই বললাম। তার আরো কিছু বই পড়ে আমি চমৎকৃত হয়েছি বিভিন্ন সময়ে। এখন হিসাব করে দেখি, ও বাবা! মোস্তফা মামুন তো কম দিন ধরে লিখছে না। কম ভালো লেখা লেখেনি। কিন্তু সেই আলোচনা তেমন হলো কোথায়? কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া আমরা কি আর হাজার ভালোকেও ভালো বলব না? এ অন্যায়।
‘চিক্কুর কাবুক’-এর কথা একটু বলি এখানে। মাহমুদুল হকের একমাত্র কিশোর উপন্যাস। যে-কোনো বিচারের বাংলা ভাষায় সেরা কিশোর উপন্যাসগুলোর একটা। এই বই নিয়ে কেউ আলোচনা করেছেন? কিশোর সাহিত্যের কিছু সভা-সেমিনারে বাধ্য হয়ে গেছি কখনো কখনো। শ্রোতা হিসেবে। ভালো লাগেনি। আমি শুনিনি কেউ একদিনও ‘চিক্কোর কাবুক’ নিয়ে কথা বলেছেন। তবে কাল হয়তো বলবে। কাল তার রত্নমানিক কখনো হারায় না।
‘কলেজ ক্যাপ্টেন’, ‘বামহাতি বাবলু’, ‘ক্যাডেট নাম্বার ৫৯৫’, ‘আমি, রনি এবং শ্যামল’, ‘বাবাবিরোধী কমিটি’ ইত্যাদি বেশ ভালো কিছু বই আছে মোস্তফা মামুনের। পাঠকপ্রিয়ও। উদ্দেশ্যমূলক সাহিত্য আলোচনার পাতে অবশ্য পড়েনি কোনোটাই। তাতে কী? আমাদের দেশের মহাÍা কিছু লেখকই শুনি ‘প্রভাবিত’। জাল সার্টিফিকেট দেন ‘উত্তীর্ণ’ সাহিত্যের। তারা কি কাল? থাক এসব অপকারী কথা। মোস্তফা মামুন ভালো লেখক কি না কাল বলবে। সামান্য একজন পাঠক হিসেবে আমি শুধু আমার মুগ্ধতা প্রকাশ করে রাখলাম এখানে।
জয়তু মোস্তফা মামুন।

Leave Comment

  1. Rafid Chowdhury says:

    আমিও দুই মোস্তফা মামুনকেই চিনি। একজন টাচলাইন থেকে লিখেন, আরেকজন তনু কাকা লিখেন।