BOOK 3

রঙের শহরের রঙিন মানুষ

মাসুদ সাহেব ঘুমান না, তবে সারা দিন শুয়ে থাকেন। হাসেন না, তবে মুখ বাঁকা করে রাখেন। পরিশ্রম করেন না, তবে ক্লান্ত ভাব ধরে থাকেন।
এসব কোনোটাই কারো জন্য ক্ষতিকর না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সবাই কেন যেন তার ক্ষতি করতে মুখিয়ে থাকে।
এখন তিনি শুয়ে আছেন। শুয়ে থাকার সঠিক কৌশলটা বহু কষ্টে রপ্ত করেছেন। নিয়মাবলির একটা হলো কান বন্ধ করে রাখা। শুয়ে কান বন্ধ করে রাখা কঠিন কাজ। চিত বা উপুড় হয়ে ঘুমালে দুই কানই খোলা। একদিকে কাত হলে এক কানের হিল্লে হয়, কিন্তু বেয়াড়া অন্যটা জেগে থাকে। আর সেই সময় দুই কানের শক্তিই যেন এই এক কানে চলে আসে। তখন মশার ভনভনে দ্বিগুণ আওয়াজ হয়; এমনকি তেলাপোকা, পিঁপড়া ইত্যাদির আওয়াজও যেন শোনা যায়। অতএব উপায় নাই। মাসুদ সাহেব অনেক ভাবলেন। অনেক গবেষণা। শেষে বেরোল উপায়। তিনি উপুড় হয়ে শোন। দুটো বালিশের একটা তখন চলে আসে মাথার ওপর। তাই দিয়ে কায়দা করে দুই কানটা এমন চেপে রাখেন যে, কানের আলাদা প্রাণ থাকলে চিৎকার করে প্রতিবাদ করত। যাদের ঘুম পাতলা, সামান্য শব্দেই ছুটে যায়, তাদের জন্য এ এক অনবদ্য আবিষ্কার। এই আনন্দে সমস্যা হলো একটা। তিনি কয়েক রাত ঘুমাতেই পারলেন না।
আরো একটা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো। দুই হাতের ওপর ভীষণ চাপ পড়ায় হাতে প্রচন্ড ব্যথা। ব্যাপারটা বেশ ভোগাল বটে, কিন্তু বৃহত্তর প্রয়োজনে ক্ষুদ্র ত্যাগ ধরে তিনি মেনে নিলেন। কয়েক দিনে বিষয়টা অভ্যাস হয়ে গেল। ব্যথাও সহনীয়।
কিন্তু সত্যিকারের ভোগান্তিটা হলো আজ। ঘুম ভাঙার পর শরীরটাকে সরলরেখার মতো লম্বা করে বিশ্রামের একটা নতুন ধরনের কায়দা আবিষ্কারের চিন্তা করছিলেন, এই সময় অঙ্কুর এসে চিৎকার করে বলল, ‘আংকেল, একটু ওঠো তো। ওঠো।’
তিনি উঠতে চাইলেন না। এই তরুণরা অকারণে উত্তেজনা দেখায়। শরীরের শক্তি ভুলভাবে প্রকাশ করে।
শুয়ে থেকেই বললেন, ‘উঠব না। যা শোনার শুয়ে শুয়ে শুনব।’
অঙ্কুর হাসল। ‘উঠবে না, না। ঠিক আছে, তাহলে শুয়ে শুয়েই এই জিনিসটা দেখো।’
মোবাইলটা সুন্দর করে তার সামনে মেলে ধরে। তার ঘুমের দৃশ্যের ভিডিও করা হয়েছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে স্মার্ট কিংবা সুন্দর মানুষের ঘুমের দৃশ্যও প্রীতিকর নয়। আর তিনি সাদাসিধা ধরনের, ভুঁড়ি ও টাকওয়ালা মধ্যবয়সি মানুষ। বালিশে মাথা চেপে ঘুমানোর পদ্ধতিও দেখার জন্য উদ্ভট। তা ছাড়া নাক ডাকার শব্দটাও বেমানান আবহসংগীতের কাজ করছে। সব মিলিয়ে প্রায় অশ্লীল একটা দৃশ্য।
নিজের ঘুমের এমন দৃশ্য দেখার পর তার রেগে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু কেন যেন মজাই লাগল তার। ভিডিওটা ছোকরা বানিয়েছে বেশ! নিজের না হয়ে অন্যের হলে ভীষণ মজা লাগত তার। আচ্ছা, নিজেকে এই মুহূর্তে মাসুদুর রহমান না ভাবলেই তো হয়।
এমন করেন মাঝেমধ্যে। নিজেকে নিজের ভেতর থেকে বের করে দেন। আর অদ্ভুত সুন্দর লাগতে থাকল দৃশ্যটা।
ধীরে ধীরে উঠে বসে বললেন, ‘অঙ্কুর, তোমার প্রতিভা আছে।’
অঙ্কুর এই প্রশংসায় একটুখানি অবাক। ঢোঁক গিলে বলে, ‘তা আছে।’
যদিও ওর বলার কথা ছিল, ‘আছে মানে… আমি দুনিয়ার সেরা।’ এই প্রজন্মের আত্মপ্রশংসা সাধারণত আকাশচুম্বী। সমর্থনসূচক কথায় ধাক্কা খেয়ে সেটা ঠিকমতো বেরোচ্ছে না।
মাসুদ সাহেবের একটু আফসোসও হচ্ছে। ফেসবুকে এটা আপলোড করলে একেবারে সুপার হিট। সেটা অঙ্কুর কামিয়ে নেবে বলে মনটা একটু খারাপ হয়। একটা সমঝোতায় আসবেন নাকি!
অঙ্কুর বলে, ‘আপনার ঘুমটা বেশ বাজে।’
‘সত্যিই বাজে।’
‘যাক, স্বীকার করছেন।’
‘অস্বীকারের উপায় নেই।’
‘সব কাজে তা-ই করলে ভালো হতো। আসল জায়গায় তো করেন না।’
‘আসল জায়গা কোনটা?’
‘এই যে যে মাসে আপনার বাজার থাকে, সেই মাসে বেশি খরচা হয়।’
‘যাও, আজ স্বীকার করে নিলাম। আমি বাজারকারী হিসেবে খুব খারাপ।’
‘তাহলে মাল ছাড়ুন।’
‘কিসের মাল?’
‘গত মাসে যে সবার এক হাজার করে বেশি গেল। পাঁচ শ করে ক্ষতিপূরণ দিন। ম্যানেজ হয়ে যাবে।’
‘ঠিক আছে, দেবো। তবে এখন না। টাকা পকেটে আসুক।’
‘সত্যি দেবেন তো? অবশ্য না দিয়েও উপায় নেই।’
বলে অঙ্কুর বিজয়ীর হাসি হেসে মোবাইলটা দেখায়। ওর স্বীকারোক্তিটা রেকর্ড হয়ে গেছে। অকাট্য প্রমাণ মুঠোয় নেওয়ার আনন্দে সে বেরিয়ে যায়।
মোবাইল নামের জিনিসটা এদের কাছে কত কাজের! আবার এরা এর ওপর কী নির্ভরশীল হয়ে গেছে! মাসুদ সাহেবের মনে হয়, যদি কোনো দৈবদুর্বিপাকে মোবাইলটা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়, তাহলে পরের প্রজন্মও হারিয়ে যাবে। সভ্যতার শেষ হয়ে যাবে এখানেই।
অঙ্কুর চলে গেছে। এখন সবাই মিলে বসবে। অঙ্কুর কী কৌশলে তাকে কাত করল, সেই নিয়ে বাহ্বা দাবি করবে। কেউ দেবে, কেউ দেবে না। তর্ক-লড়াই চলবে।
চলুক। কিন্তু একটা কাজ ছেলেটা করে দিয়ে গেছে। মাসুদ সাহেব নিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেছেন। এখন তৃতীয় পুরুষ হয়ে নিজেকে দেখছেন।
মন্দ লাগছে না। নিরপেক্ষ আত্মবিশ্লেষণ হচ্ছে। তার বয়স পঞ্চাশ। প্রায় ষাট। তাতে সুবিধা হয়। বাড়তি কিছু শ্রদ্ধা পাওয়া যায়। এই মুরব্বিকে বসতে দে, বয়স্ক মানুষের সঙ্গে অত দরাদরি করতে নেই¬-এমন নানা অকারণ সুবিধা তিনি পেয়ে থাকেন।
তিনি কী করেন না করেন তাই নিয়ে একটা বিভ্রান্তি আছে। সত্যি বললে তার নিজের কাছেও। দৃশ্যমান কোনো আয়ের উৎস নেই। তবু তার টাকা-পয়সার যে কোনো সংকট নেই, সেটা একটা কৌতুহলের ব্যাপার সবার জন্য। তবে তিনি দেখেছেন, সব সমস্যার সমাধান টাকা দিয়ে করা যায়। শুরুতে সবাই প্রশ্ন করত খুব। পরে যখন দেখল, তিনি সময়মতো ভাড়া এবং খাবারের টাকা দিতে পারছেন, তার ওপর কারো দরকার হলে ধারও পাওয়া যাচ্ছে, তখন আর কারো বিশেষ মাথাব্যথা নেই। নিজের কাজে লাগলে বা লাগার সুযোগ থাকলে রহস্যময় টাকা, অবৈধ টাকা- কোনো কিছুই আর মানুষের কাছে সমস্যা না।
আর টাকা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তার মনে পড়ল, মতিঝিলে বন্ধু সেলিমের কাছে হাজার বিশেক টাকা পাওনা। আজই নিয়ে নিতে হবে। সেলিমের ঠিক নেই। মাঝেমধ্যে হারিয়ে যায়। লোকে বলে জেলে যায়। সেলিম বলে ব্যাঙ্ককে যায়। দুটোর কোনোটাই তার পছন্দের জায়গা নয়। তিনি মাথা ঘামান না। সেলিম টাকা নেয়। সুদসহ সময়মতো ফেরত দিয়ে দেয়। তার রহস্যময় সব আয়ের সেলিমও একটা উৎস।
বেরোনোর জন্য তৈরি হয়ে নিচ্ছেন। ছোটন এসে বলল, ‘কাকা, আজ দুপুরে বাইরে খাবেন?’
‘খেতে পারি।’
‘উফ্! আজকেই বাইরে যাবেন। শিং মাছ রান্না করছিলাম। আপনার পছন্দ দেখেই এনেছি।’
‘ঠিক আছে। রাতে এসে খাব না হয়।’
‘রাতে কি আর সেই মজা পাবেন! শিং মাছ খেতে হয় গরম গরম। মুখে ঝাল লাগবে, ঝোলে গাল ভরে থাকবে।’
ছোটন ওদের সঙ্গে থাকে। ফকিরাপুলে এক প্রেসে কাজ করত। অঙ্কুর ওকে বাসায় নিয়ে এসেছে। বাজার আর রান্নায় একটা ছেলে যে এভাবে জীবন উৎসর্গ করে দিতে পারে, তা এর সঙ্গে দেখা না হলে তিনি জানতেই পারতেন না।
তিনি ওকে স্কুলে ভর্তি করে দিতে চেয়েছিলেন। বয়স নেই, তবু পাড়ার এক স্কুলে ধরাধরি করে ঢুকিয়ে দিলেন। কয়েক সপ্তাহ পর একদিন দেখেন, স্কুলের সব মাস্টার বাসায়।
ছোটন দাওয়াত দিয়েছে। রান্না করে খাওয়াবে।
খাওয়াল। তারপর ঘন ঘন ওরা আসতে থাকলেন। আর ছোটন পরীক্ষায় বিপুল নম্বর পেতে থাকল।
তিনি একদিন ওকে পড়াতে বসে অবাক। কিছুই পারে না। নম্বরের উৎস যে রান্নার মধ্যে, বুঝতে পারলেন। পরে দেখা গেল, বাজারেরও ভূমিকা আছে। প্রায় সব স্যারের বাসার বাজারটাও সে-ই করে দেয়।
হেড স্যারের কাছে গেলেন। হেড স্যার মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, ‘ছেলেটার অবিশ্বাস্য বাজার করার স্কিল। আমি মুগ্ধ।’
‘কিন্তু ওর শিক্ষা?’
‘এটাই ওর শিক্ষা। সবাই কি জজ-ব্যারিস্টার হবে নাকি? ও এই যে রান্না করে, বাজার করে-এই সেবামূলক মানসিকতাকে তুচ্ছ করতে নেই।’
‘তা ঠিক আছে, কিন্তু অক্ষরই তো চিনতে পারে না।’
[বাকী অংশ মূল বইয়ে]


রঙের শহরের রঙিন মানুষ’ পাওয়া যাবে বইমেলায় অনন্যা’র প্যাভিলিয়নে।

Ronger Shohorer Rongin Mamush

Leave Comment