অনেক বছর আগে একবার ঢাকা থেকে সিলেটে যাচ্ছি। সঙ্গী এক বিলেতি ভদ্রলোক। বিলেতিদের এদেশে এলে এক সমস্যা। বাংলাদেশিদের চেয়ে বেশি বাংলাদেশি হয়ে যেতে চায় কেউ কেউ। বন্ধুসূত্রে চেনা ভদ্রলোক দেশে এসেই অস্থির করে তুলেছেন। এই পুরান ঢাকায় জ্যাম দেখতে যাবেন, তো ওই রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে চায়ে ভিজিয়ে বিস্কুট খাবেন। চায়ে আধাভেজা করে বিস্কুটটা মুখ পর্যন্ত আনাও যে একটা বিরাট দক্ষতার ব্যাপার তার কসরত দেখে সেদিন জানলাম। সঙ্গে এ-ও জানলাম, এদেশের মানুষ ইংরেজিতে কথা বলতে খুব ভালোবাসে। যার সঙ্গে দেখা হয়, সে-ই সাদা চামড়া দেখে দুয়েকটা ইংরেজি বাক্য বলে। একজন হাত চেপে ধরে ভদ্রলোকের কুশল জানতে গেল। কিন্তু ‘ইউ’ বলার পর আর কোনো শব্দ মুখে আসে না, হাতও ছাড়ে না। টানাটানি করে উদ্ধার পেতে হলো। মজা দেখতে আবার লোকও জমে গেল।
এরপর ভদ্রলোকের বাঙালি হওয়ার চেষ্টা বিসর্জন দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বিলেতিরা খুব সহজে কিছু ছাড়ে না। সিলেটে যাব। তিনি বায়না ধরলেন, বাসে যাবেন। সাধারণের সঙ্গে। অগত্যা বাসে চড়লাম। হাইওয়েতে উঠতেই বাস তার আপন চেহারা দেখাতে শুরু করল আর বিলেতির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। আমাদের গাড়ি ওভারটেক করতে গিয়ে উল্টোদিকের আরেকটা গাড়ির মুখোমুখি, ‘ওহ মাই গড’ বলে মুখ ঢেকে চিৎকার করে উঠলেন। ভেবেছিলেন নিশ্চিত মৃত্যু। কিছুক্ষণ পর মারা যাননি দেখে হাত থেকে মুখ সরিয়ে বিস্ময়, ‘কীভাবে সম্ভব?’
‘কী?’
‘সামনের গাড়িটা কোথায় গেল?’
গর্ব করে বললাম, ‘সঠিক সময়ে দুই ড্রাইভার স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে একে-অন্যকে পথ করে দিয়েছে।’
বলতে না বলতেই আরেকটা গাড়ির মুখোমুখি। সত্যি বললে, নিজেরই মনে হলো, এবার বোধহয় গেলাম। এবং গেলাম না।
পরের ঘটনাটা খুবই কৌতুকের। ভদ্রলোক যখন দেখলেন এভাবে মৃত্যুর মুখে গিয়েও না মরে ফিরে আসা যায় তখন পুরো বিষয়টা উপভোগের সিদ্ধান্ত নিলেন। ‘নাউ আই অ্যাম ইনজয়িং’ বলে এমন নাচানাচি শুরু করলেন যে বাসটা বিপজ্জনকভাবে আরেকটা গাড়ির মুখোমুখি হলে শিশুতোষ উত্তেজনায় উৎসাহ দেন ড্রাইভারকে, ‘গো গো’। তারপর শেষ মুহূর্তে বিপদ এড়ালে প্রচ- হাততালি।
সড়কে প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল দেখতে দেখতে পুরনো এই অভিজ্ঞতাটা মনে পড়ে। প্রতিদিন ১০-১২ জন মারা যায়। কোনো কোনোদিন আরও বেশি বা কম। কিন্তু যতবার দুর্ঘটনার সম্ভাবনা তৈরি হয় তার তুলনায় এই সংখ্যাটা সামান্যই আসলে। সড়কে, বিশেষত হাইওয়েতে যারা যান প্রত্যেকেই মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন। শেষমুহূর্তে ড্রাইভাররা সেকেন্ডের হিসাবটা ঠিক রাখতে পারেন বলে। যখন পারেন না, তখনই চূড়ান্ত ট্র্যাজেডি। পাঁচ ভাই বা এক পরিবারের ৬-৭ জন চলেন চূড়ান্ত পথে। আমরা পত্রিকায় খবর ছেপে, ঢাকায় বসে আহাজারি করি কিন্তু যে ব্যবস্থা আর ব্যবস্থাপনার মধ্যে সড়ক ফেলে রেখেছি তাতে একদিন হাজার লোকের মৃত্যুও অস্বাভাবিক না। সড়ক দুর্ঘটনাকে তাই দুর্ঘটনা মনে করি না একটুও। এগুলো ঘটানো ঘটনা! ইচ্ছা করে কেউ ঘটায় না বটে কিন্তু অনিচ্ছার অঘটন বলার সুযোগই নেই। সড়কের নিয়ম নেই, ড্রাইভারের লাইসেন্স নেই, বাসের ফিটনেস নেই। আসলে কারও কিছু নেই।
এসবই আবার জানা যায় দুর্ঘটনা ঘটলে। আচ্ছা সব গাড়িই কি হেলপার চালায়? দুর্ঘটনার দুয়েকদিন পর বীর বিক্রমে ড্রাইভারকে গ্রেপ্তার করা হয়। দেখা যায়, নেশাসক্ত চেহারার কৈশোর পেরুনো এক ভাঙাচোরা মানুষ। জানানো হয়, সে হেলপার এবং তার লাইসেন্স নেই। শেষ কবে লাইসেন্সওয়ালা ড্রাইভারকে অ্যাক্সিডেন্ট করতে দেখেছি মনেই পড়ে না। এমনই এক লাইসেন্সহীন ধৃত হেলপারকে টিভিতে দেখে এক বন্ধু রেগে মেগে বলল, ‘ইস, এখন বীর পুরুষের মতো ধরেছেন। আগে ধরলেন না কেন?’
বুদ্ধিজীবী গোছের এক বন্ধু বলে, ‘ধরেনি কে বলল?’
‘ধরেছে? তাহলে অ্যাক্সিডেন্ট করার সুযোগ পেল কীভাবে?’
‘ধরেছে, খেয়েছে, ছেড়েছে…তারপর অ্যাক্সিডেন্ট করেছে।’
কে ধরেছে, কী খেয়েছে এসব কথা উহ্য থাকাই ভালো। ভুলে যেতে পারি, তাই প্রাসঙ্গিক একটা গল্প এখনই বলে নিই। মহাসড়কে দুই গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে। কেউ মারা যাননি কিন্তু দুটো গাড়ির ক্ষয়ক্ষতি মারাত্মক। পুলিশ এসে গাড়ি দুটো পরীক্ষা করে একজনকে বলল, ‘আপনি থানায় চলুন।’
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, ‘আমি যাব কেন? দোষ তো ওর।’
‘আপনিই যাবেন।’
‘আমি তো বামদিকেই ছিলাম। সে ওভারটেক করতে গিয়ে…। দেখতে পাচ্ছেন না?’
‘পাচ্ছি। তবু আপনিই যাবেন।’
‘কেন?’
‘কারণ, উনি আমাদের মন্ত্রী মশাইয়ের আত্মীয়। কাজেই আপনাকেই থানায় যেতে হবে।’
এখানে তবু একজন থানায় গেছেন। আমাদের এখানে কাউকেই বোধহয় যেতে হয় না। একজন মন্ত্রী মশাইয়ের আত্মীয় হলে আরেকজন বাস মালিক সমিতির গর্বিত সদস্য। কাউকে ধরা যায় না। যার যা খুশি করে। দেখে দেখে মনে হয়, এক ইলিয়াস কাঞ্চন আর ছাত্র মারা গেলে তার ক্ষুব্ধ সহপাঠীরা ছাড়া এসবে কারও কিছু এসে যায় না।
জানি কেউ কেউ বলবেন, কিছু আসে যায় না কেন বলল! কত সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করি। সচেতনতামূলক কার্যক্রমে বক্তৃতা দিতে দিতে গলা ভেঙে কথা বেরোয় না। ঠিক যে, এসব কিছু আয়োজন হয়। কিন্তু তাতে কাজ যে হয় না এর কারণ সম্ভবত আমরা মূল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছি না। একবার বড় একটা দুর্ঘটনার পরদিন গাড়ি নিয়ে হাইওয়েতে নেমেছি। দুর্ঘটনা নিয়ে টিভি-পত্রিকায় বিস্তর হা-হুতাশ চলছে। কাজেই রাস্তায় একটু সচেতনতা দেখব বলে মনে হয়েছিল। কীসের কী! সেই পাল্লা দেওয়া। জীবনবাজি রেখে গাড়ি চালানো। একটু খটকা লাগল। এই যে এত আলোচনা এর জের রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না কেন? অবাক আবিষ্কার, ড্রাইভারদের অনেকে ঘটনা সম্পর্কে জানেই না। জানে এমন একজনকে পাওয়া গেল। সে নিস্পৃহ গলায় বলে, ‘আমি কী করব? আমি তো আর অ্যাক্সিডেন্ট করিনি।’
‘কিন্তু করতেও তো পারেন। একটু সতর্ক হয়ে চালানো উচিত না!’
‘সতর্ক হয়ে চালাই আর চাকরি হারাই।’
‘মানে?’
‘গাড়ি নিয়ে …টার মধ্যে না পৌঁছালে ফিরতি ট্রিপে যাত্রী পাব না। অন্য কোম্পানির গাড়িতে সব লোক উঠে যাবে। চাকরি থাকবে?’
ড্রাইভার, যার হাতে অনেক মানুষের জীবন, তাকে এমন চাপে ফেলে মালিকরা প্রথম অপরাধী। না, দ্বিতীয় হবেন। প্রথম তারা, যাদের দায়িত্ব এসব দেখভাল করে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা। এসবই পুরনো শিক্ষা। সেদিন আরেকটা নতুন শিক্ষাও হলো। যে শ্রেণিটা আমাদের গাড়ি চালায় তাদের জীবনবোধই আসলে অন্যরকম। খুব খেয়াল করলে দেখবেন, সাধারণ পরিবারের, স্বল্পশিক্ষিত মানুষেরাই কাজটা করেন। আর দশজন সাধারণ পরিবারের মানুষের মতো এরাও জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত খেয়ে জর্জরিত। বেঁচে থাকাটা কঠিন বলে জীবনটা খুব মূল্যবান কিছু নয়। নিজের জীবনই যেখানে মূল্যবান নয় সেখানে অন্যের জীবন নিয়ে খুব ভাবনা আর থাকে না। এখানেই আমাদের সচেতনতা কার্যক্রমের ব্যর্থতা। এদের মনস্তত্ত্ব বুঝে কাজ করি না বলে সেই মন পর্যন্ত আমাদের আওয়াজ যায় না। ওরা চলে ওদের মতো। যাদের থামানোর কথা তারা ঘুমায়। আর অভাগারা মরে ভাগ্য আর গাড়ির চাকার ফেরে। সমাধান কোথায়?
আচ্ছা এই কৌতুকটা শুনে দেখি তো, এভাবে সমাধান করা যায় কিনা!
গুরুতর সড়ক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে এক ড্রাইভার কয়েকজনকে মেরে ফেলেছে। তার অবস্থাও সংকটাপন্ন। লোকজন তাকে উদ্ধার করে নিয়ে এলো পাশের একটা হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালের সামনে গাড়ি থেকে নামাতেই তার চিৎকার, ‘আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আর জীবনে অ্যাকসিডেন্ট করব না।’ বিষয়টা বোঝা গেল একটু পরে। হাসপাতালের সামনে ‘শেল’ কোম্পানির একটা হোর্ডিং ছিল, কেউ একজন এমনভাবে এর সামনে দাঁড়িয়েছিল যে এর ‘ঝ’ অক্ষরটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। তাই দেখা যাচ্ছিল ‘যবষষ।’ ড্রাইভার ভেবেছিল, সে দুর্ঘটনা ঘটানোর অপরাধে নরকে চলে এসেছে। তাই এই আর্তি। আমাদের ড্রাইভারদের তো আর দুনিয়ার কিছু দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এভাবে নরকের ভয় দেখিয়ে যদি…।
এক ছাত্রকে শিক্ষক দুর্ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞান দিচ্ছেন। বললেন, ‘আচ্ছা যদি দেখো যে সামনের সেতু ভাঙা, কিন্তু একটা গাড়ি সেটা না জেনে এগিয়ে যাচ্ছে তাহলে তুমি কী করবে?’
ছাত্র বলল, ‘আমি লাল কাপড় নেড়ে চালককে সতর্ক করব।’
‘যদি তাতেও সে সতর্ক না হয়।’
‘তাহলে আর কী করা যাবে। আমি আমার ছোট বোনকে ডেকে নিয়ে আসব। ওর আবার এক্সিডেন্ট দেখার শখ।’
দেখে দেখে মনে হয় আমাদের সবার আসলে দুর্ঘটনা দেখার শখ পেয়ে বসেছে। অতএব…। চলুন পরের দুর্ঘটনা পর্যন্ত অপেক্ষা করি।
প্রথম প্রকাশঃ দেশ রূপান্তর
লিংকঃ অতএব পরের দুর্ঘটনার অপেক্ষা