Bill Lorry

একজন আটাত্তর বছর বয়সীর গল্প


মোস্তফা মামুন, সিডনি থেকে ::

‘আমার বয়স কত জানো?’

‘জানি। আটাত্তর।’

‘আটাত্তর বছর বয়সী কারো পক্ষে কি আর এখনকার ক্রিকেট সম্পর্কে মূল্যায়ন করা সম্ভব?’

‘ঠিক এখনকার ক্রিকেট না, আপনার ক্রিকেট ক্যারিয়ার, অধিনায়কত্ব, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে তো মূল্যায়ন সম্ভব।’

বিল লরি এবার রাজি হলেন।

বয়স হয়ে যাওয়া মানুষকে লাইনে আনার সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে স্মৃতির সরণিতে নিয়ে যাওয়া কিন্তু বিল লরির ক্ষেত্রে সেখানেও সতর্ক থাকতে হয়, কারণ যদিও তিনি সাবেক অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের সর্বকালের সেরাদের তালিকায় জায়গা পাওয়া একজন, টেস্ট ব্যাটিং গড় ৪৭.১৫ তবু তাঁর স্মৃতির হাইওয়েতে খানাখন্দ বড় বেশি। অধিনায়কত্ব করে যত না নন্দিত হয়েছেন অধিনায়কত্ব হারানোর ঘটনায় তার চেয়ে বেশি আলোচিত। ক্রিকেট ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ তো মনে করেন তাঁকে সরিয়ে ইয়ান চ্যাপেলকে অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক করাতে বরং অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট রক্ষা পেয়েছে। তাঁর সময়ের সাবধানী আর রক্ষণাত্মক খেলা টেস্ট ক্রিকেটেরই আকর্ষণ কমিয়ে দিয়েছিল, ইয়ান চ্যাপেল মারকুটে মনোভাব দিয়ে যেটা ফিরিয়ে আনেন।সত্যি বললে, চ্যাপেলের যে আক্রমণাত্মক ভঙ্গির ওপর আধুনিক পেশাদারি মানসিকতার ভিত তৈরি অনেকের মতে সেখানেও লরির একটা অবদান আছে। পরোক্ষ অবদান। লরিকে রক্ষণাত্মক এবং বিচ্ছিন্ন মনোভাবের জন্য যখন সিরিজের মাঝখানে সরিয়ে দিয়ে ইয়ান চ্যাপেলকে অধিনায়ক করা হয় তখন চ্যাপেল ভাইদের বড়জন খুশি হননি একটুও। ক্ষুব্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছিলেন।সিদ্ধান্তটা সম্ভবত ছিল লরি যে পথে হেঁটেছিলেন তিনি ঠিক তার উল্টো পথে হাঁটবেন। হেঁটেছেনও। আর তাই সেই রাতেই কাছের বন্ধুদের ঘোষণার মতো করে বলছিলেন, ‘ওরা বিলের সঙ্গে যে আচরণ করল আমার সঙ্গে সেটা করতে পারবে না।’

কিন্তু সেসব দিয়ে তো আর শুরু করা যায় না। শুরু করতে হয় এমন কিছু দিয়ে যাতে আটাত্তর বছর বয়সের একজন সুখের স্বাদ পান।অতীতে ডুব দিয়ে সেরকম সুখের সুযোগও আছে কিন্তু। অধিনায়ক হিসেবে ভারতে গিয়ে ভারতের বিপক্ষে সিরিজ জিতেছিলেন তিনি, যেটা ছিল ৩৫ বছর পর ভারতের মাটিতে ভারতকে হারানো। এখন যেমন তখনও বিষয়টা তেমনই ছিল। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের জন্য উপমহাদেশ ছিল অন্য গ্রহের মতো অপরিচিত, সেখানে গিয়ে অপরিচিত পরিবেশে খাবি খেতে হতো! তখন দুজন আম্পায়ারই স্বাগতিক দেশের হতেন বলে সেদিক দিয়েও মুখোমুখি হতে হতো প্রতিকূলতার। খেলোয়াড়দের মাঠের নিরাপত্তায় এখনকার মতো নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা ছিল না। সুযোগে দর্শকরাও খেলোয়াড়দের জীবন কঠিন করে দিত প্রায়ই। বাধার অত দেয়াল জয় করেছিলেন কিসের শক্তিতে? লরি একটু ভেবে বললেন, ‘তখন আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল দুটো। একটা অ্যাশেজ, সেটা দেশে-বিদেশে যেখানেই হোক। এরপর উপমহাদেশ। বিশ্বকাপ, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি এসব না থাকায় ওই দুটোই ছিল মূল মিশন। উপমহাদেশে সেই সিরিজে সব কিছু ঠিকঠাক হয়েছিল। কে জানে, আমি নিজে স্পিন ভালো খেলতাম বলে ওই জায়গাটায় অত অস্বস্তি বোধ করতাম না।’ কিন্তু তাহলেও সেই সিরিজে ঝামেলা হয়েছিল যথেষ্ট। অন্তত দুইবার দর্শকরা অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের ওপর এমন খেপে গিয়েছিল যে শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে। একটা টেস্টে ভেঙ্কটরাঘবনের আউট নিয়ে ঘটনা এত দূর গড়িয়েছিল যে উড়ে আসা চেয়ার মাথায় লেগে চোট পান লরিও। কিন্তু ইতিহাস বলে, এমনিতে সাবধানী ক্রিকেটার হলেও লরি সেদিন বিক্ষুব্ধ গ্যালারি, উত্তেজিত স্বাগতিক কর্তৃপক্ষ সবার বিরুদ্ধে গিয়ে খেলা চালিয়ে যাওয়ার গোঁ ধরেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার জয়টা ছিল তখন সময়ের ব্যাপার আর তাই কোনোভাবে ম্যাচ বন্ধ করতে রাজি হননি তিনি। তাহলে যে তাঁকে রক্ষণাত্মক অধিনায়ক হিসেবে টিপ্পনী কাটা যায়! এটা কি ইতিহাসের অবিচার? লরি একটু যেন খেপে গিয়ে বলেন, ‘কে কিভাবে কী মনে রাখে সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। আমি অধিনায়ক হিসেবে দলের সেরা অর্জন নিশ্চিত করার চেষ্টা করতাম। যখন জেতা সম্ভব ছিল তখন জয়। এখন কোনো সময় যদি দেখা যেত জেতা যাবে না তখন না হারা নিশ্চিত করাকে কেউ রক্ষণাত্মক হওয়া মনে করলে আমি রক্ষণাত্মক। কিন্তু যারা লাফিয়ে গিয়ে হারের সঙ্গে কোলাকুলি করে বীরপুরুষ হয় আমি সেই ধরনের বীর হতে চাইনি কখনও।’

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৭০-৭১ সালের যে সিরিজটাতে অধিনায়কত্ব হারান লরি সেটা ছিল দীর্ঘ একটা সিরিজ। শুরুতে সূচি ছিল ছয় টেস্টের, বৃষ্টিতে একটা টেস্ট পণ্ড হওয়াতে শেষে টেস্ট যোগ করা হয় আরেকটি। আর সেই শেষ টেস্টের আগে সিরিজ হার নিশ্চিত হয়ে গেলে সিদ্ধান্ত হয় লরিকে দল থেকেই বাদ দিয়ে দেওয়ার। একটা অভিযোগ আসে, ধূমপান এবং মদ্যপান কোনোটাই করেন না বলে সঙ্গী খেলোয়াড়দের সঙ্গে খুব বেশি আড্ডা হয় না তাঁর। হয়ে থাকেন এক প্রকার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। যখন সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয় ততক্ষণে দুই টেস্টের মাঝের ছুটি কাটিয়ে মেলবোর্নের বাড়ি থেকে তিনি বেরিয়ে গেছেন। নির্বাচকরা কোনোভাবেই আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। লরি প্রথম খবরটা জানতে পান পথে রেডিওর খবরে। তারপর প্রথম যখন সাংবাদিকরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন তখন নাকি বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে নতুন অধিনায়কের নেতৃত্বে খেলব। অসুবিধা কী? অন্যের নেতৃত্বে খেলতে আমার আপত্তি নেই।’ সাংবাদিকরা তাঁর এই কথাতে এতটাই বিব্রত হয়ে যান যে তাঁরা কেউ আর সাহস করে এই কথাটা বলতে পারেননি যে ‘আপনি আর খেলবেন কী। দলেই তো নেই।’ দলে না থাকার খবরটা পান এর কয়েক ঘণ্টা পর। তখনও ক্রিকেট পুরোপুরি অধিনায়কের খেলা, সেই আমলে সিরিজের মাঝখানে একজন অধিনায়কের এভাবে ছিটকে পড়ার ঘটনাটা এত অবিশ্বাস্য যে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে লরি তাই অধিনায়কত্ব করার চেয়ে হারানোর গল্পেই বেশি স্মরণীয়। একজন বয়স্ক মানুষ, যিনি নিজেই নিজের বয়স ঘোষণা করে একরকম নিষ্কৃতি চান জগতের যন্ত্রণা থেকে, তাঁকে সেই জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া ঠিক শোভন হয় না। প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে করতে হয় এভাবে, মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেল, আরো কিছুদিন খেলতে পারলে নিশ্চয়ই আপনার ভালো লাগত! উত্তরটা একটু চমকে দেওয়া, ‘আমি জানি না ভালো হতো না খারাপ হতো। খারাপও হতে পারত। বরং যেখানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ হয় সেখান থেকেই আমি নতুন ক্যারিয়ার শুরু করে দিই। প্রত্যেকটা শুরুর জন্য একটা শেষ দরকার।’

খুব সম্ভব হঠাৎ করেই শুরু হওয়া সেই ক্যারিয়ারটা দারুণ সফল ছিল বলে ক্রিকেট ক্যারিয়ার হুট করে শেষ হওয়ার দুঃখটা আর সেভাবে নাড়া দেয় না। হ্যাঁ, ওই শেষ টেস্টেই তিনি বসে যান কমেন্ট্রি বক্সে। সেই যে বসলেন তারপর প্রায় তিরিশ বছর। অদ্ভুত মাদকতায় শ্রোতাদের মাতিয়ে রেখেছেন দুর্দান্ত বিশ্লেষণ, আকর্ষণীয় উপমা আর অনন্য উপস্থাপনায়। সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক টনি গ্রেগের সঙ্গে দুর্দান্ত একটা জুটি তৈরি হয়েছিল তাঁর। মাইকের পেছনে দুজনের কৃত্রিম ঝগড়া, কথার লড়াই জুটিটাকে দিয়েছিল অন্য মাত্রা। সেই জুটিটা ভেঙে গেছে ২০১২ সালে, যখন পরপারের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন গ্রেগ।

গ্রেগের কথা আসতেই থেমে যান লরি। এমন স্তব্ধতা নেমে আসে যে তাঁকে তখন আর কঠিন সময়ে চারদিকের তোপ সামলে চলা স্থির মস্তিষ্কের অধিনায়ক মনে হয় না, মনে হয় না পাহাড়ের মতো অবিচল দৃঢ়তায় দুরন্ত বোলিং সামলানো ওপেনার। মনে হয় সত্যিই একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষ, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত দেখতে দেখতে এখন যিনি ক্লান্ত। বন্ধুর বিদায় বেলা শেষের ডাক হয়ে জগৎ-ক্রিকেট এসব থেকে তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গেছে বহুদূর।

একজন আটাত্তর বছর বয়সীর সঙ্গে এরপর আর কথা বাড়ানো যায় না! উচিতও না!

প্রথম প্রকাশঃ কালের কন্ঠ, ২৪ মার্চ, ২০১৫
লিংকঃ একজন আটাত্তর বছর বয়সীর গল্প

Leave Comment