‘এই প্যান্টে চলবে না। জিন্সের প্যান্ট নেই?’ ‘আছে।’ ‘এই চুলেও চলবে না।’ ‘চুলে কোনো সমস্যা ভাই? চুল তো আছে।’ ‘না চুলের স্টাইল। এই তেলমাখা চিরুনি দেয়া চুলে চলবে না। ড্যাশিং- ডিয়ারিং স্টাইল চাই। দুইটা স্টাইল আছে। হয় সাইড পাতলা, আর্মি ছাঁট। নইলে লম্বা চুল, পাংকু স্টাইল।’ ‘পাংকুটা পারব না ভাই, আর্মিটাই ভালো।’
ক্যাম্পাস ১৯৯৫
‘এই প্যান্টে চলবে না। জিন্সের প্যান্ট নেই?’
‘আছে।’
‘এই চুলেও চলবে না।’
‘চুলে কোনো সমস্যা ভাই? চুল তো আছে।’
‘না চুলের স্টাইল। এই তেলমাখা চিরুনি দেয়া চুলে চলবে না। ড্যাশিং- ডিয়ারিং স্টাইল চাই। দুইটা স্টাইল আছে। হয় সাইড পাতলা, আর্মি ছাঁট। নইলে লম্বা চুল, পাংকু স্টাইল।’
‘পাংকুটা পারব না ভাই, আর্মিটাই ভালো।’
‘এই লেতু-ফেতু দাঁড়ানোতেও হবে না। বুক থাকতে হবে ফোলা।’
‘বুক ফুলাব।’
‘আর বসলে পা থাকতে হবে পায়ের ওপর তোলা। মনে থাকবে তো?’
‘জি মনে থাকবে। বুক থাকবে ফোলা আর পা পায়ের ওপর তোলা।’
‘গেস্ট রুমে কিংবা গেটে বসতে হবে। পাহারা দিতে হবে, যাতে অপজিশন হলের দিকে চোখ ফেলতে না পারে।’
‘বসব। পাহারা দেব, যাতে অপজিশন পজিশন না নিতে পারে।’
‘নেতৃবৃন্দের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতে হবে। সালাম দিতে হবে।’
‘নেতৃবৃন্দকে সম্মান করব। তাঁরা তো সম্মানিত মানুষ।’
‘ঠিক আছে, তাহলে রুম নাম্বার ৫৩০-এ চলে যাও।’
মিতুল ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিল না। হলে সিট পাওয়া এত সোজা!
নেতার কাছে ওকে নিয়ে এসেছে ওর বন্ধু ফখরু। ফখরু ও হলে থাকতে চায় শুনে বলেছিল, ‘ব্যাপার না। বিকালেই চইলা আসো। ব্যবস্থা কইরা দিমু নে।’
মিতুল মনে করেছিল কথার কথা। কতজনই তো এই দুই মাসে এসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু ক্লাস শেষে বেরোনোর সময় পেছন থেকে আবার ডাকে ফখরু, ‘দোস্ত, তাইলে তুমি কয়টায় আসতেছ?’
‘সত্যিই আসব?’
‘তাইলে কি মিথ্যা মিথ্যা আসবা নাকি?’ ফখরু খুব উঁচুদরের রসিকতা হয়ে গেছে মনে করে হাসে। মিতুলও খুব হাসে। এখন ফখরুকে খুশি রাখতে হবে।
‘আসবা। একটা ছোট্ট ইন্টারভিউ। হ্যাঁ-হুঁ করবা, ব্যস, বাকি ব্যবস্থা আমার।’
‘তাহলে চলে আসব।’
‘পাঁচটায় আইসা আমারে মামার চায়ের দোকানে খুঁজবা। না হইলে গেস্ট রুমে গিয়া নাম বলবা। ওরা খুঁইজা বাইর কইরা দিব।’
‘ব্যাগ-ট্যাগ নিয়া আসব?’
‘তাইলে আবার কী? কাঁথা-বালিশ ছাড়া থাকবা ক্যামনে?’ ফখরু আবার হাসে। ওর বিশ্বাস এটাও ভালো রসিকতা হয়েছে।
বিকাল পাঁচটার অনেক আগেই মিতুল জিয়া হলের গেটে এসে নেমেছিল। ব্যাগও সঙ্গে ছিল কিন্তু তবু তার ঠিক ভরসা হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। এই দুই মাস হলে জায়গা পেতে ধরাধরি কিছু কম করেনি।
প্রথমে গিয়েছিল মামার বন্ধু সাব্বির মামার কাছে। জিয়া হলে ওর সিট পড়েছে শুনে মামা বললেন, ‘কোনো সমস্যাই না। সাব্বির আছে। জিয়া হল তো ওর বেড রুম।’
মামার সঙ্গে একদিন যাওয়া হলো সাব্বির মামার বাসায়। গিয়ে অবশ্য জিয়া হলে এই লোকের মালিকানা আছে, এমন কিছু মনে হলো না।
মহাখালী তিতুমীর কলেজের উল্টা দিকের গলিতে ঢুকে অনেক খানাখন্দ পেরিয়ে একটা দোতলা বাসা। তার নিচতলায় একটা মেসমতো জায়গায় সাব্বির মামা থাকেন। সাব্বির মামাকে পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল সঙ্গী আরেক-জনকে। সে একটা নতুন প্যান্ট বানিয়ে এনেছে। সেই প্যান্ট বানানো যে খুব সুন্দর হয়েছে, দারুণ ফিটিং এমন আলোচনায় অংশ নিতে হলো। স্বীকার করতে হলো যে নীলক্ষেতের চেয়ে মহাখালী এলাকায় অনেক ভালো প্যান্ট বানানো হয়।
দ্বিতীয় দিনে সাব্বির মামাকে পাওয়া গেল। মন দিয়ে শুনে বললেন, ‘একসময় তো হলটা আমাদেরই ছিল। এখন পোলাপাইন বেয়াদব হয়ে গেছে। দেখি কী করা যায়।’
গেল আরো দুই দিন। প্রতিদিনই সাব্বির মামা বললেন, ‘তোমার হলে ওঠা নিয়ে আমি কিছু আলোচনা করেছি। আরো কিছু আলোচনা করতে হবে।’
সেই কিছু আলোচনা আর শেষ হলো না। সাব্বির মামাই নিখোঁজ হয়ে গেলেন। তৃতীয় দিন গিয়ে দেখে বাসায় তালা। সে একটু ধাক্কাধাক্কি করছিল, উপরের তলা থেকে এক মহিলা বের হয়ে এসে কঠিন গলায় বললেন, ‘সাব্বিরকে চেনো?’
‘জি।’
‘লিপাকে চেনো?’
‘জি না।’
মহিলা মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘সাব্বিরকে যারা চেনে তাদের কেউ লিপাকে চেনে না। কী আশ্চর্য…অথচ…’
মহিলা কথা না বাড়িয়ে ভেতরে চলে গেলেন।
এবার বেরিয়ে এলেন একজন মাঝবয়সী পুরুষ। এমনিতেই চোয়াল-ভাঙা চেহারায় একটুও মাধুর্য নেই, মাত্রই ঘুম থেকে উঠে আসার কারণে মেজাজটাও বিগড়ানো।
তাঁরও প্রশ্ন, ‘সাব্বিরকে চেনো?’
‘জি।’
‘লিপাকে চেনো?’
‘জি না।’
‘সাব্বিরের বন্ধু-পরিচিতদের কেউ লিপাকে চেনে না। তাহলে ঘটনাটা ঘটল কীভাবে?’ ভদ্রলোকের গলায় রাগের বদলে এখন দ্বিধা।
চলে যাচ্ছিলেন, মিতুল জিজ্ঞেস করল, ‘লিপা কি আপনার মেয়ে?’
‘হ্যাঁ।’
‘সাব্বির মামা কি ওনাকে নিয়ে পালিয়েছেন নাকি?’