‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে বাঁচিয়া ছিল’—কথাটা বহুল ব্যবহৃত বলে এর আবেদন আর নেই খুব একটা। তবু মনে হলো পুরনো ক্লাব মোহামেডানের জন্য এই পুরনো উপমাটাই সবচেয়ে বেশি সত্য। মোহামেডান শেষ হয়ে যাওয়ার পর যেন আমরা আরো তীব্রভাবে বুঝতে পারি আমাদের খেলায়, আমাদের জীবনে মোহামেডানের কী অসীম গুরুত্ব। যদিও ঠিক নিশ্চিত নই, মোহামেডান নিজেরাও সেসব জানে কি না। জানতে পারে, তবে ভাবে না। নিশ্চিত।
মধ্য নব্বইয়ে সাংবাদিকতায় এসে দেখি চারদিকে সব মোহামেডান। বিএনপি ক্ষমতায় এবং সেই সূত্রে ক্রীড়াঙ্গনে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে থাকারা প্রায় সবাই এই ক্লাবের। সমর্থক সংখ্যার হিসাবেও একটা অদ্ভুত ব্যাপার। ঢাকার বাইরে বড় হওয়ার কারণে সেখানে দেখেছি মোহামেডান-আবাহনী সমর্থক সংখ্যায় তীব্র লড়াই, ঢাকায়ও কাছাকাছি হবে; কিন্তু আদি যে ঢাকা সেখানে মোহামেডান শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ। আমার কাছে সে রকম কোনো গবেষণা নেই, তবু পর্যবেক্ষণে মনে হলো এর ভেতরে যেন আদি ঢাকা আর নতুন ঢাকার বিরোধেরও একটা ব্যাপার আছে। পুরান ঢাকার আদি মানুষেরা মনে করে ঢাকার নবাবদের তৈরি মোহামেডান তাদেরই ক্লাব, যখন আবাহনী হচ্ছে সেই ঢাকার ক্লাব, যেটা আসলে ঠিক ঢাকা নয়। সারা দেশ থেকে আমরা যারা জীবন-জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় আসি এবং ঢাকাকে ভোগ করি কিন্তু ভালোবাসি না, তাদের কাছে আবাহনী সেই ‘বহুজাতিক বহিরাগত’ মানুষের দল। তাই মোহামেডান-প্রেমের মধ্যে বুঝি সেই অংহটুকু আছে। মুসলিম জাতীয়তাবাদকে একভাবে বহন করে চলা মোহামেডান এখানে এসে ঢাকাত্বেরও প্রতীক। এটা ভালো না মন্দ সেই আলোচনায় যাচ্ছি না; কিন্তু বাস্তবতা হলো, এরাই ঢাকার মাঠের গরিষ্ঠ দর্শক। তাই ফুটবল যখন ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে মিরপুর বা অন্য কোথাও যায় তখন তারা আর সেখানে যায় না। একধরনের বিযুক্তি বোধ করে। সত্যি বললে, তাদের কাছ থেকে ফুটবল সরিয়ে নেওয়াতেই প্রথম ক্ষতিটা হয়েছিল ফুটবলের। আজকে মহামারির আকার নেওয়া ফুটবলবিমুখতার উৎস খুঁজলে মনে হয় প্রথম পেরেকটা এভাবেই পড়েছিল। এখন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ফিরে এসেছে বটে; কিন্তু ওই যে তাল কেটে যাওয়া, সেটা আর জোড়া লাগেনি। এখানে, এভাবেই মোহামেডান মানে ফুটবল।
গবেষণা বা মূল্যায়ন, এসব আমাদের দেশে খুব একটা হয় না। খেলা নিয়ে মুখে যত হাওয়া-হাওয়া রব ওঠে, অভিজাত ভাবনায় এটা শেষ পর্যন্ত তরুণদের ফুর্তি-ফার্তার বিষয়ই। তাই মোহামেডান এবং আবাহনীর সামাজিক গুরুত্বটা ঠিকভাবে চিত্রিতই হলো না। আবাহনী যে দুঃসময়ে আওয়ামী রাজনীতির একমাত্র ধারক হয়ে উঠেছিল এবং গভীরভাবে ভাবলে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে টিকিয়ে রাখার একটা প্ল্যাটফর্ম, সেই কৃতিত্ব কেউ দেয় না। মোহামেডানের অবস্থা আরো খারাপ। মোহামেডান মুসলিম স্পোর্টস ক্লাব নামে প্রথমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৭ সালে, ৯ বছর পর কলকাতা মোহামেডানের অনুসরণেই নাম হয় মোহামেডান। নামেই বোঝা যাচ্ছে মুসলমানদের সঙ্গে এর একটা সংযোগ আছে। অতি প্রগতিশীল রূপধারী কেউ কেউ দেখি এই অপরাধে মোহামেডানকে অভিযুক্ত করে বসেন; কিন্তু বিষয়টা দেখতে হবে তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে। সেই অবিভক্ত ভারত বা বাংলায় এটা সাম্প্রদায়িকতা নয়, পিছিয়ে থাকাদের সম্পৃক্ত করার ক্রীড়া আন্দোলন। এবং খুব যে মুসলিম লীগের রাজনৈতিক চিন্তার অংশ হিসেবে মোহামেডান হয়েছিল এমন নয়, কিন্তু যা হয়, এ রকম একটা দল যখন হয় তখন তার সঙ্গে সেই সম্প্রদায়ের মানুষ সংযুক্ত বোধ করে। মোহামেডান ভালো দল করল। জিততে শুরু করল। তখন শিক্ষা-সংস্কৃতিতে পিছিয়ে থাকা শ্রেণি এই এক জায়গায় নিজেদের জয় দেখে হীনম্মন্যতা থেকে বেরিয়েও আসতে শুরু করল। তাই সত্যি যদি বলি তাহলে মুসলমানদের মূল স্রোতে আনতে কিংবা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় কলকাতা এবং ঢাকা মোহামেডানের একটা ভূমিকা আছে। পরোক্ষ হয়তো কিন্তু অন্তর্গতভাবে খুব জোরালো। প্রশ্ন হলো, মোহামেডান নিজেরা এর অন্তর্নিহিত শক্তিকে কতটা অনুভব করেছে? দেশ স্বাধীনের পরের পরম্পরা বরং অন্য ছবি দেখায়।
বাংলাদেশ হওয়াটা একভাবে মুসলিম জাগরণের রাজনীতির হার। মোহামেডানের মূলও ধাক্কা খায় স্বাভাবিক। কিন্তু ক্রীড়া দলের ক্ষেত্রে সুবিধা এই যে মাঠের সাফল্য ঠিক থাকলে অন্য সব ঝুটঝামেলা সামাল দেওয়া সম্ভব। মোহামেডান তত দিনে সাফল্য এবং নিজস্বতায় এমন উঁচুতে যে সব কিছুর আঁচ বাঁচিয়ে দিব্যি মাঠের সাফল্য দিয়ে চলা সম্ভব ছিল। সমস্যা হলো আবাহনী। নতুন চিন্তা, রাজনৈতিক শক্তির সহায়তা মিলিয়ে তরুণদের মধ্যে এমন জোয়ার তৈরি হলো যে মোহামেডানের মনে হলো আমরা বোধ হয় ভেসে যাচ্ছি। মাঠের মোহামেডান ভেসে গেল না; কিন্তু ভেসে গেল পেছনের চিন্তা। মুখে ঐতিহ্যের কথা রইল বটে; কিন্তু ঐতিহ্যের কথা আসলে সেই ধরনের ক্ষেত্রেই আওড়ানো হয় যখন দেখা যায় বর্তমানের হিসাবে এরা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। মোহামেডানের পেছনের মানুষদের মনে হলো, আবাহনী যখন একটা ধারার প্রতীক হয়ে উঠেছে তখন আমাদেরও সেই রকম পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। ভুলটা এখানেই হলো যে আবাহনী শেখ কামাল প্রতিষ্ঠা করেছেন, কাজেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ওদের লেগে থাকার দোষটা ঠিক কাঁধে চাপবে না। মুসলিম লীগ তত দিনে শেষ, ওদের রাজনৈতিক চিন্তার মানুষেরা বিএনপিতে নতুন আশ্রয় খুঁজছেন, মোহামেডানও যেন সেখানে আশ্রয় নিতে চাইল। মাঝখানে আবার জাতীয় পার্টি যখন, তখন মোহামেডান তাদেরও আশীর্বাদমুখী। মিলিয়ে মোহামেডান হয়ে গেল একরকম ক্ষমতার সুবিধাভোগকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান। ওদিকে আবাহনী নিপীড়িত বিরোধী দল। সরকারের সুবিধাভোগীরা বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় সব সময়ই নিন্দিত, আর নিপীড়িতদের পক্ষে থাকে সাধারণ আবেগ। আবাহনী মাঠে পয়েন্ট হারিয়ে, রেফারিদের ভুল বাঁশির শিকার হয়ে, দলবদলে অন্যায্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও মানুষের মনে। আর মোহামেডান সব জিতেও প্রাপ্য সামাজিক মর্যাদাটা ঠিক পায় না। যেমন ইতিহাস মোহামেডানকে পিছিয়ে থাকা মুসলমানদের জাগিয়ে তোলার বাহবাটা দেয় না। যেমন এই কথাও কেউ মানে না, এ দেশের ফুটবলের যে সিংহাসন ছিল একসময় তার সবচেয়ে বড় পাওয়াটা ছিল মোহামেডানের জোগান দেওয়া।
কয়েক বছর আগে এক আবাহনী সমর্থক বলছিলেন, ‘মোহামেডানের সব সাফল্য নানা রকম বদান্যতায় পাওয়া। সাফল্য হচ্ছে আবাহনীর। যেভাবে লড়াই করে…’
‘তা ঠিক। মোহামেডান তো সব জিতেছে রেফারিদের বাঁশি আর আম্পায়াদের আঙুলে।’
একটু বাজিয়ে দেখতে বললাম, ‘পুরো ঠিক। নইলে ওয়ান্ডারার্স-ভিক্টোরিয়া হয়ে যেত সেই সত্তরের দশকে।’
‘আচ্ছা তাহলে মোহামেডান যে পিরুজি ক্লাবকে হারাল, উত্তর কোরিয়ার এপ্রিল টোয়েন্টি ফাইভকে…আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মোহামেডানের সাফল্য যে অনেক বেশি সেটাও কি রেফারিদের কারণেই…’
সমর্থকটি ‘না’ ‘কিন্তু’ ইত্যাদি করতে থাকলেন।
সত্যি বললে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মোহামেডানের সাফল্য বাংলাদেশের যেকোনো ক্লাবের চেয়ে অনেক বেশি। দেশীয় সাফল্য-সমর্থনেও এই শতকের শুরু পর্যন্ত সবার ওপরেই ছিল।
কিন্তু সমস্যা বোধ হয় ছিল ওটাই। ওরা আবাহনী হতে চেয়েছিল! আবাহনী শেয়ার বিক্রি করে লিমিটেড কম্পানি করল। মোহামেডানও যেন সে রকম কী একটা করল। আবাহনী কমপ্লেক্স করবে। মোহামেডানেরও সে রকম বহুতল ভবনের আওয়াজ। এভাবেই মোহামেডান এগিয়ে থেকে পিছিয়ে পড়ার উদাহরণ। আবাহনী দুঃসময় সামলে নিতে পারে, কারণ তার যে রাজনৈতিক যোগাযোগ সেই রাজনীতি আবাহনীকে নিজেরই মনে করে। সহায়তা করে চলে সব সময়। মোহামেডানের ক্ষেত্রে সম্পর্কটা সাময়িক এবং সুবিধার বলে দুঃসময়ে সামনের মানুষেরা সরে পড়ে। যেমন সরে আছে গত দেড় দশক। তাই মোহামেডান নিজেকে হারিয়ে খোঁজে।
এবং তখনই মোহামেডানের নির্বাচন। নতুন কমিটি। যেভাবে মোহামেডানপ্রেমীরা জেগে উঠলেন তাতে আশার আলো দেখেন কেউ কেউ। আমি খুব আলো দেখি না, কিন্তু দেখতে চাই। ছবি হয়ে চোখে ভাসে সেই সব মোহামেডান সমর্থক, যাদের ভালোবাসায় যুক্তি-বুদ্ধি-স্বার্থ কিচ্ছু নেই, শুধু আছে হৃদয়। কত কত মোহামেডান সমর্থক ফোন করেন। ভারী হয়ে আসা এই নিঃশ্বাসগুলোতে যে আকুতি তা শুনে মনে হয় মোহামেডান ক্লাবের প্রাণ থাকলে ডুকরে কেঁদে উঠত।
ইতিহাস মোহামেডানকে প্রাপ্য মর্যাদা দেয়নি। বর্তমান একরকম বদলা নিচ্ছে। নিজেকে চিনতে এবং বুঝতে না পারার যে অক্ষমতা সেটাই আসলে মোহামেডানকে এই তলানিতে এনে ঠেকিয়েছে।
নতুন সভাপতি এবং কমিটির কাছে তাই চাওয়া সামান্য। মোহামেডানকে অনুভব করুন। এর ঐতিহাসিক এবং সামাজিক শক্তিকে বিশ্বাস করুন। তাহলেই হবে।
আচ্ছা, মোহামেডানের এই চরম উন্মাদনার নির্বাচনে দেখলাম আবাহনীঘেঁষা কেউ কেউ ভোট দিচ্ছেন। আবাহনীর মানুষ মোহামেডানের সদস্য হবেন কেন? বলছিলাম না, আবাহনী হতে গিয়ে, এভাবেই আবাহনীর পেছনে চলে মোহামেডান নিজেদের সর্বনাশটা করেছে!
প্রথম প্রকাশঃ কালেরকন্ঠ
প্রকাশ কালঃ ১৮ মার্চ, ২০২১