1 2 3 Logo

হতে পারো বড় মানুষের চেয়েও বড়

আমাদের পাড়ায় একবার একটা ছেলের সন্ধান মিলল। ছেলেটির বিশেষত্ব হলো সে খুব খেতে পারে। এক গামলা ভাত রেখে দিলে কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ করে এর-ওর দিকে তাকায়। আরো কিছু ভাত দেয়া যাবে কি!
ছোট শহরে যেকোনো ঘটনাই বড় ঘটনা। দেখতে মানুষ উপচে পড়ে। তা দশ বছরের ফজলুকে দেখতেও ভীড় জমতে থাকল। ফজলুর বাবা ছিলেন ভ্যানচালক, এমন কিছু রোজগার নেই, তিনি বরং খুশিই হলেন। মানুষ জন তার ছেলেকে দেখতে আসছে। এটা-ওটা আনছে, যার অনেক কিছুই নিজেরাও খাওয়া যাচ্ছে। মন্দ তো নয়।
খবরটা শুনে আমরাও ঠিক করলাম একদিন দেখতে যাব। আমাদের নেতা হচ্ছেন রাফি মামা, যার গল্প আস্তে আস্তে তোমাদের বলব। কিশোরদের দলবদ্ধ যেকোনো পরিকল্পনা বিগড়ে দিতে বড়রা তৈরি থাকেন। রাফি মামা হচ্ছেন ঠিক তার উল্টা। আমাদের যেকোনো বাঁদরারি পরিকল্পনা শুনলেই রাফি মামা বলেন, ‘দারুণ। চল।’
একবার আমরা স্কুলের বইতে পাহাড় ভ্রমণের একটা গল্প পড়ে পাহাড়ে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলাম। ঠিক করলাম, সামনের ছুটিতে যেভাবেই হোক পাহাড়ে যাব। রাফি মামা শুনে বললেন, ‘চল।’
‘চলব মানে কী?’
‘আজকেই চল।’
‘আজকে! একদিনের মধ্যে যাওয়া যায় নাকি? স্কুল ছুটি হোক।’
মামা একটু ভেবে বললেন, ‘স্কুল ছুটি মানে তো পরীক্ষার পর… সেই পরীক্ষায় কেউ পাস করবি, কেউ ফেল। তখন অনেকের মন খারাপ থাকবে। তাছাড়া ততদিন উত্তেজনা থাকবে কি না তাই বা কে জানে?’
আমরা তবু ঠিক রাজি হলাম না। আর মামা আজ বললেই তো আর আজ যাওয়া হয়ে যাচ্ছে না। আমাদের অঞ্চলে সেরকম পাহাড় নেই। যেতে হলে ট্রেন-বাসে করে অনেক দূর যেতে হবে। একদিনে সেই আয়োজন তো সম্ভব নয়।
রাতের বেলা রাফি মামার তলব। তাঁর ঘরে গিয়ে দেখি ট্রেনের টিকেটও কাটা হয়ে গেছে। রাফি মামা বললেন, ‘আমরা যাব আজই। বহস্পতিবার রাত। শুক্র-শনি ঘুরে রোববার থেকে আবার স্কুলে। চলবে না!’
চলবে মানে দৌড়াবে!
এই হলেন রাফি মামা। এমন একজন নেতা পাওয়াতে সুবিধাটা হলো আমরা এমন অনেক কিছু করতে পারতাম যা অনেকক্ষেত্রে কল্পনাও করা যায় না।
যাই হোক, রাফি মামার নেতৃত্বে আমরা ফজলুকে দেখতে রওনা হয়ে গেলাম। রাফি মামা ওর জন্য বিস্তর খাবার কিনলেন। প্যাকেটে ভাত-মাংসের তরকারী, মিস্টি, চিপস, কোক। আমাদের মধ্যে জহির ছিল একটু পেটুক প্রকৃতির। বলল, ‘মামা ফজলুর মতো হয়ে গেলে তো মন্দ হতো না। স্কুলের চাপ নেই, স্যারের মার নেই। ঘরে বসে বসেই খাওয়া-দাওয়া।’
রাফি মামা উদাস গলায় বললেন, ‘ফজলুকে দেখে ফেরার পথে তোদেরকেও হোটেলে বসে খাওয়াব। তবে শর্ত আছে।’
‘কী শর্ত?’
‘তোদের কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।’
একটু দমে গেলাম। ভালো খাওয়া-দাওয়ার জন্যও পরীক্ষা দিতে হবে।
ফজলু বসে ছিল ঘরের সামনের একটা চটের বস্তার উপরে। পেছনে যে ভাঙ্গাচোরা ঘর তারচেয়ে চটের বস্তার বসার আয়োজনটাই বোধহয় বেশি স্বস্তিকর। প্রচুর দর্শনার্থী। মজা নিতে আসা লোকের সংখ্যাই বেশি। মাঝবয়সী একজন আমাদের দেখে বললেন, ‘বাহ! অনেক কিছু নিয়ে এসেছেন দেখছি। ওর পেটটা পুরো একটা ড্রাম। যা দিবেন সঙ্গে সঙ্গেই নাই।’
রাফি মামা কিছু না বলে হাসেন।
এসব জায়গায় বুদ্ধিজীবী ধরণের মানুষও থাকে। তাদের একজন বললেন, ‘বাবা একটা ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। ছেলেটাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে। তা-না, শুধু খাওয়াচ্ছে।’
তাঁর সঙ্গের মানুষটি আরও নিষ্ঠুর। ‘ছেলে যেটুকু খাচ্ছে না সেটা রেখে দিচ্ছে। পরে বাপ-মা খাবে। কাজকর্ম না করে এভাবেই তো ওদের চলে যাবে।’
ফজলু কিছু কায়দা কানুন এর মধ্যে শিখে নিয়েছে। নতুন কেউ গেলেই নবাবী আমলের সিনেমার মতো গলায় বলে, ‘আসসালামুআলাইকুম ওয়া রহমতুল্লাহি।’
রাফি মামা চমৎকারভাবে উত্তর দিয়ে ওর পাশে বসলেন। খাবারের প্যাকেট খুলে দিলেন।
আমরা হলে আগে খেতাম চিপস-চানাচুর। ফজলু খেতে শুরু করল ভাত।
আমাদের অবাক করে কয়েক মুহূর্তেই পুরো প্লেট শেষ।
দর্শকদের কেউ তাতে হাততালি দিচ্ছে। কেউ শিস। কেউ কেউ আবার, ডাক্তার-কবিরাজ করার মতামত প্রকাশ করছে।
রাফি মামা কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফজলু তোমার কী সবকিছু খেতে ইচ্ছে করে নাকি শুধু ভাত?’
‘সবকিছু।’
‘ও আচ্ছা।’
‘তবে ভাত বেশি ভালো লাগে।’
মামা উঠে বিদায় নিতে নিতে বললেন, ‘ঠিক আছে আমরা আরেকদিন আসব।’
মামার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ফেরার পথে আমরা হোটেলে বসেছি। মামা বললেন, ‘তোদের কী মনে হয়? ছেলেটা এত খেতে পারে কীভাবে?’
জহির বলল, ‘সবাই তো আমাকে পেটুক বলে খেপায়! এখন দেখলে তো দুনিয়ায় কত পেটুক আছে!’
মামা বললেন, ‘আমার প্রশ্নের উত্তর দে।’
আমরা ভাবতে থাকলাম।
মামা বিষণ্ণ গলায় বললেন, ‘খেয়াল করেছিস ও ভাতটা বেশি পছন্দ করে।’
‘হ্যাঁ।’
‘এর কারণটা কী?’
আমি বললাম, ‘ঠিক বুঝতে পারছি না। মিষ্টি-কেক বাদ দিয়ে কেউ ভাত খায় নাকি? ছেলেটা বেশ বোকা।’
মামা একটু ভেবে বললেন, ‘ব্যাপারটা আসলে তোরা ঠিক বুঝবি না। তোরা যেমন বিস্কুট-চকলেট-চানাচুর ইত্যাদি খেতে পাস সমাজের এই শ্রেণীর বাচ্চারা জন্মের পর থেকে সেগুলো সেভাবে পায় না। ফলে এগুলোর স্বাদটাই অনেক ক্ষেত্রে ওরা জানে না। ওরা খাবার বলতে বুঝে শুধু ভাত। তাই ভাতটাই অনেক বেশি পছন্দের।’
‘কিন্তু একসঙ্গে এত ভাত কীভাবে খায়?’
মামা করুণ গলায় বললেন, ‘ঠিক জানি না। তবে আমার মনে হয়, ছোটবেলা না খেয়ে থাকার কষ্টের সঙ্গে ওদের পরিচয় হয়ে যায়। ফলে, যখন যতটুকু পায় ততটুকু খেয়ে নেয়, যদি পরের বেলা খাবার না জুটে। এভাবেই একসঙ্গে অনেক বেশি খেয়ে ফেলার অভ্যাসটা তৈরি হয়ে যায়। ফজলুরটা হয়তো আমরা দেখছি কিন্তু গরীব মানুষের বাচ্চাদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই এটা সত্য। ওরা এত খেতে পারে যা দেখলে আমরা চমকে যাব।’
এই গল্পটা তোমাদের শোনালাম এজন্য যে তোমাদের যাদের সব ঠিক আছে, খেতে পারো, স্কুলে যেতে পারো, বেড়ানোর সুযোগ আছে তাদের তুলনায় কিছু বাচ্চার জীবন কত কষ্টের!
এখন এই বিষয়ে তোমাদের হয়তো করার তেমন কিছু নেই। তোমরা ছোট। নিজেদের জীবন উপভোগ করবে। আর সঙ্গে শুধু ওদের কথাটা একটু ভাববে। একটু মনে রাখবে। তাহলেই যখন বড় হবে তখন দেখবে ওদের সমস্যা সমাধানের জন্য তোমার মনই তোমাকে ঠেলবে। ব্যস। আমাদের দেশটা হয়ে উঠবে সোনার দেশ।
এই যেমন ঈদে তুমি অনেক কাপড় পেয়েছ। বাবা দিয়েছেন, মা দিয়েছেন। চাচা-মামা সবাই দিয়েছ।
এখন যদি তুমি তোমার বাবাকে বলো, ‘বাবা আমার তো অনেক জামা। একটা জামা কম কিনে দিয়ে তার টাকা দিয়ে ঐ রাস্তার ছেলেকে আমরা কিছু কিনে দেই।’
তোমার বাবা তখন কী করবেন জানো? রুমাল বের করে চোখ মুছবেন। আর মনে মনে বলবেন, ‘আমার ছেলেটা আমার চেয়েও বড় হয়ে গেছে।’
তোমরা হয়তো শরীরে আর বয়সে এখনও ছোট! কিন্তু চাইলে এখনই হতে পারো বড় মানুষের চেয়েও বড়।

Leave Comment