ঢাকা থেকে সিলেট যাচ্ছিলাম কয়েক মাস আগে। ট্রেন যাত্রা এমনিতে আমার খুব পছন্দের ভ্রমণ। হাঁটাচলা করা যায়; বাসের মতো একটা সিটে বন্দি হয়ে থাকতে হয় না। একটু বেশি দাম হলেও খাবারদাবার মিলে। বাথরুম-টাথরুমেরও একরকম ব্যবস্থা আছে। এর বাইরে আরেকটা অদ্ভুত কারণেও ট্রেন আমার প্রিয়। সেটা হলো নাম। ভাবা যায়, বাংলাদেশের একটা ট্রেনের নাম ‘ঊর্মি গোধূলী।’ এ ছাড়া তূর্ণা নিশীথা, সাগরিকা, পাহাড়িকা- দারুণ সব মনকাড়া নাম! বাংলাদেশে দুটো জিনিসের নামকরণের মধ্যে চূড়ান্ত সৌন্দর্যবোধের পরিচয় মেলে। একটা হলো ট্রেন, আরেকটা হলো নদী। মধুমতী, গোমতী, কপোতাক্ষ- উফ্, নদীর নামগুলো শুনলেই মন ভালো হয়ে যায়।
এসব ভাবতে ভাবতে ঠিক খেয়াল করিনি কখন পাশে এসে এক মধ্যবয়সি ভদ্রলোক বসেছেন। আমার সঙ্গীভাগ্য সাধারণত খুব একটা ভালো হয় না কিন্তু আমি সেটা নিয়ে কখনোই ভাবি না। বরং যেরকম সঙ্গীই আসুক, পাশে তাঁকে উপভোগের চেষ্টা করি। একবার আমার পাশে একজন পকেটমার বসেছিল, পরে এক স্টেশনে সে পকেট কাটতে গিয়ে ধরা পড়ে বেদম মার খায়। অন্য কেউ হলে পকেটমারের পাশে এতক্ষণ বসেছিল ভেবে হয়তো গা ঘিনঘিন করত কিন্তু আমার বিষয়টাকে দারুণ উপভোগ্য মনে হলো। একজন পকেটমার ঠিক ঠিক কী করে, কী কায়দায় সে মানুষকে ভোলানোর চেষ্টা করে- সেসব সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানলাভ তো হলো। পছন্দের কিংবা প্রিয় মানুষদের সঙ্গে তো সব সময় মিশি, অপছন্দের বা অচেনা মানুষদের জানার জন্য ট্রেন তাই আমার কাছে আদর্শ জায়গা।
তখন শীত প্রায় চলে গেছে। তবু ভদ্রলোকের পরনে কমপ্লিট সুট। একটু খেয়াল করে দেখলাম, ভেতরে একটা ওয়েস্ট কোটও আছে। সুট পরা মানুষকে দেখলে আমি অদ্ভুত একটা বিষয় খেয়াল করি। টাইটা ঠিকমতো বাঁধা তো। টাই বাঁধাটা কঠিন একটা কাজ। যে মানুষটা সেই কাজটা সুন্দরমতো করতে পারে তাঁকে আমার বেশ সক্ষম মানুষ মনে হয়।
সেই সক্ষম মানুষটি কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সক্ষমতার পরিচয় দিতে শুরু করলেন। নিজে থেকেই বলতে থাকলেন, ‘ছি, দেশের কী অবস্থা! ট্রেনের মধ্যে এত গরম। বদরুলকে বললাম এসির টিকিট কাটতে।’
বুঝতে পারছ! ভদ্রলোক জানাতে চাইছেন যে তিনি সাধারণত এসি কামরায় ভ্রমণ করেন। এবার বদরুল নামের অপদার্থের পাল্লায় পড়ে তাঁর এই দুর্গতি।
এরকম মানুষের একটা সুবিধা হলো এদের সঙ্গে খুব সহজে খাতির করা যায়। তাঁর বড়লোকি গল্পের সঙ্গে একটু তাল মেলালেই এরা একেবারে ইয়ার-দোস্ত হয়ে যান।
হাসতে হাসতে বললাম, ‘এসি টিকিটের কথা আর বলবেন না। রেলের মানুষজন সব ব্ল্যাকে বিক্রির জন্য রেখে দেয়।’
মানুষটি বললেন, ‘ঠিক বলেছেন। সব চোর। দেশটা একেবারে শেষ হয়ে গেল!’
আমিও ‘দেশ শেষ হয়ে গেছে’ জাতীয় একটা হাসি দিলাম। ভদ্রলোক আমাকে আরো আপন করে নিলেন।
এক জায়গায় ট্রেন একটু স্লো হতেই বললেন, ‘বুঝলেন, কেন গাড়ি স্লো? এখানে মাল পার্টি নামবে।’
‘মাল পার্টি মানে?’
‘চোরাকারবারিরা। ওদের সঙ্গে ট্রেনের লোকদের লাইন আছে। এখানে নামিয়ে দেবে, যাতে পুলিশ এড়িয়ে ওরা নির্বিঘ্নে জায়গামতো যেতে পারে। দেশটা একেবারে শেষ হয়ে গেল।’
এর মধ্যে দুটো বাচ্চা ছেলে ঠান্ডা পানি এবং কোকাকোলা নিয়ে উঠেছে। ভদ্রলোক ডাক দিলেন, ‘এই, তোর কোক কত?’
‘কোকের যা দাম।’
‘দোকানের কোকের দাম তো আমি জানি। তোরটার দাম কত?’
‘আমারটারও একই দাম। ১৫ টাকা।’
আমি ভেবেছিলাম ভদ্রলোক বোধহয় ধারণা করছেন, দোকানের চেয়ে এদের কাছে দাম বেশি হবে। এরা যেহেতু জিনিসটা দোকান থেকে বহন করে আনছে, তখন সেই হিসাবে লাভ করতে দু-এক টাকা বেশি নেবে।
কিন্তু অবাক হয়ে শুনলাম ভদ্রলোক বলছেন, ‘পাঁচ টাকায় দিবি?’
আমি স্তম্ভিত। কোকাকোলার দামাদামি তো কখনো শুনিনি।
ছেলেটি বলল, ‘আপনে কোক খাইছেন কোনো সময়?’
‘চুপ বেয়াদব। বল পাঁচ টাকায় দিবি কি না’
‘হে হে, পাঁচ টাকায় কোক খাইবার চায়!’ ছেলেটি টিটকিরির হাসি হাসে। অন্য মানুষজনও মজা দেখার জন্য উঁকিঝুঁকি মারছে। কোকের দাম নিয়ে দরাদরি প্রায় সবার অভিজ্ঞতাতেই নতুন।
ভদ্রলোক একটুও বিব্রত না হয়ে জনতার উদ্দেশে বললেন, ‘ভাই, এই বিচ্ছুগুলা কী করে জানেন! কোকের বোতল থেকে কোক বের করে তাতে পানি মেশায়। এক বোতল দিয়ে বানায় পাঁচ বোতল। সেই হিসাবে পাঁচ টাকা তো বেশিই বলেছি। পাঁচ টাকা হলে দে আর না হয় ভাগ।’
ছেলেটির এরপর আর দাঁড়িয়ে থাকার প্রশ্ন নেই। ভাগল।
ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে বিজয়ীর হাসি হেসে বললেন, ‘দেখলেন তো। আসল কথা বলাতেই ভেগেছে। এই বিচ্ছুরাও দুই নম্বরি শিখে গেছে। দেশটা একেবারে শেষ হয়ে গেল।’
কোকের বোতলে পানি মেশানোর ব্যাপারটা প্রমাণিত নয়। তা ছাড়া সামান্য দুটো টাকার জন্য যে বাচ্চারা এত পরিশ্রম করছে, ওদের অপরাধী হিসেবে ভাবতে মন সায় দেয় না।
ভদ্রলোকের সঙ্গে আর কথা বাড়াব না ঠিক করে একটু তন্দ্রার ভাব করলাম। একটু ঘুমও এসে গিয়েছিল বোধহয়। ঘুমটা ভাঙল, টিকিট চেকারের ধাক্কায়।
টিকিট দেখাই। আশপাশের মানুষজনও টিকিট বের করে। শুধু দেখি সেই ভদ্রলোক জানালার দিকে তাকিয়ে। এমন ভাব যেন তার টিকিট দেখানোর দরকারই নেই কোনো।
টিটিই তাঁকে বললেন, ‘আপনার টিকিটটা?’
তিনি মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘আপনি একটু ঘুরে আসুন না।’
‘কোথা থেকে ঘুরে আসব?’
‘বদরুল আপনাকে কিছু বলেনি?’
‘বদরুল কে?’
‘ও, আপনাকে বলেনি বোধহয়। যা-ই হোক, একটু আসুন আমার সঙ্গে।’
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। টিটিই কী বুঝে যেন তাঁর সঙ্গে গেল।
আমার কৌত‚হল বোধ খুব তীব্র না। তবু কেন যেন পেছন পেছন গেলাম। গিয়ে দেখি কামরার কোনায় ভদ্রলোক এক শ টাকার একটা নোট বের করে টিটিইর হাতে দিয়ে বলছেন, ‘এই নেন। আপনারও লাভ। আমারও লাভ।’
আমার আর দেখতে ইচ্ছে হলো না। সিটে ফিরে এলাম। কিছুক্ষণ পর ভদ্রলোক ফিরলেন খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। আমি জিগ্যেস করলাম, ‘বদরুলটা কে?’
‘বদরুল হচ্ছে আমার পাড়ার ছেলে। ছোটবেলা থেকেই আমাকে বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করে। বড়দের প্রতি তাঁর দারুণ রেসপেক্ট।’
‘বড়দের রেসপেক্ট করা ছাড়া সে আর কী করে?’
‘ও আচ্ছা! সে এই ট্রেনের অ্যাটেনডেন্ট। পাশের কামরাতেই ডিউটি করছে।’
‘এজন্যই আপনি টিকিট কাটেননি?’
‘বদরুল আছে। আর টিকিটের কী দরকার! আর ভাড়া তো দিলামই। তবে শালা এক শ টাকাতেও খুশি না। আরো চায়। আরে ব্যাটা, যা পাচ্ছিস সেটাই তো বেশি। আমি টিকিট কেটে নিলে তো এক টাকাও পেতি না। এত লোভ! দেশটা একেবারে শেষ হয়ে গেল!’
আচ্ছা, তোমাদের সঙ্গে যদি কখনো এরকম কোনো মানুষের দেখা হয়, তাহলে তাকে কী বলবে!
বলবে, দেশ আসলে একা একা শেষ হয় না। শেষ করে মানুষেরা। সেই মানুষেরা, যারা অন্যদের অন্যায় নিয়ে ভাবতে ভাবতে নিজেদের চেহারা দেখার সময়ই পায় না।
আচ্ছা, এদেরকে একটা করে আয়না উপহার দিলে কেমন হয়!
![আয়না উপহার 1 1 2 3 Logo](https://mustafamamun.com/wp-content/uploads/2021/12/1-2-3-Logo-400x270.png)