আনিসউদ্দিন সাহেব বৃহস্পতিবার দিন বাজারের আল্পনা ভেরাইটিস স্টোর থেকে একটা আয়না কিনে ফেললেন। আর পুরো বাজারে হৈ হৈ পড়ে গেল।
একে বৃহস্পতিবারের বাজারে বেশি লোক থাকে বলে যেকোনো বিষয় নিয়েই উত্তাপ তৈরি হয়। তার ওপর আনিস সাহেব, যাকে কেউ কোনোদিন একটা সুইও কিনতে দেখেনি, পাছে ভুল করে টাকা খরচ করে ফেলেন এই ভয়ে যার পকেট সেলাই করা থাকে বলে জনশ্রুতি, সেই তিনি কিনা পুরো একটা আয়না কেনার টাকা বের ফেললেন! উত্তেজনা স্বাভাবিক।
সেলিম হেয়ার ড্রেসারে বসে আয়েশ করে চুল কাটাচ্ছিলেন ফরিদ মাতব্বর। চুল কাটার সময় সেলিম শ্রোতাদের রুচিমতো গান চালায়। পুরোনো আমলের মানুষ ফরিদ সাহেব। ‘চুমকি চলেছে একা পথে…’ শুনতে শুনতে চোখ বন্ধ করে কল্পনার চুমকিকে দেখছিলেন, এই সময় আয়নার খবরটা সেলিমের কানে এলো। উত্তেজনায় ওর ক্ষুরটা একটু জোরে চলল। ফরিদ সাহেব ‘উফ্’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। সেলিম দেখল, কানের নিচে কয়েক ফোঁটা রক্ত। এরপর আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। সেলিম ক্ষুর হাতে নিয়েই দিলো দৌড়। এ-ও খুব উল্লেখযোগ্য ঘটনা নয়। ক্ষুর হাতে নিয়ে সেলিমকে প্রায়ই দৌড়াতে দেখা যায়। দুই কারণে। কোনোদিন ফরিদ মাতব্বরের মতো কারো রক্তপাত ঘটিয়ে আত্মরক্ষার্থে। কোনোদিন পাওনাদারদের সন্ধানে। সেলিমের কাছে চুল কাটানো শেষে ‘আসছি’ বলে অনেকে ভেগে যায়। সেলিম তাদের অপেক্ষায় থাকে। খোঁজ পাওয়া গেছে শুনলেই দৌড়ায়। ক্ষুরটা তখন অস্ত্র। এভাবে প্রায়ই ওর টাকা উদ্ধার হয়ে যায়।
গার্লস স্কুলের সায়েন্স টিচার অনীল সেন আনুর জিলিপির দোকানে বসে বিবিসির সান্ধ্য আয়োজন শুনছিলেন। গোলমাল-হৈচৈ বেশি বলে রেডিওটা একেবারে কানে চেপে রেখেছেন। বাজারে এসে মানুষ কেন হৈ-হল্লা করে তার মাথায় ঢোকে
না। বাজারে মাথা রাখতে হয় ঠান্ডা, তাহলেই না দেখেশুনে ভালো জিনিস ঠিক দামে কেনা যায়। তা না। চিৎকার। বকোয়াস। তিনি রেডিওটা আরো চেপে ধরেন। আর তখনই ক্ষুর উদ্যত সেলিম মিষ্টির দোকান পার হচ্ছিল। কে যেন বলে উঠল, ‘আজ কে যে মরে…’
ভালো কথা অনীল সেনের কানে যায় না। খারাপ কথা ঠিক শুনে ফেলেন। মরার কথা শুনেই মনোযোগ হারিয়েছিলেন। রেডিওটা হাত থেকে ছিটকে পড়ল। ছিটকে পড়াটা এমন কোনো সমস্যা না। সমস্যা হলো সেটা গিয়ে পড়ল একেবারে গরম জিলিপির হাঁড়িতে। আনু ময়রার বাজারের দিনে দম ফেলার সময় থাকে না। লোকে এদিন এত এত জিলিপি খায় যে জিলিপির হাঁড়ি আর ওর হাত ঘুরতেই থাকে। অমনোযোগে সে রেডিওটাকেও কয়েক পাক ভেজে ফেলল। তারপর যখন খেয়াল হলো তখন গরম খুন্তিটা তুলে অপরাধীকে তেড়ে মারতে গেল। সঠিক অপরাধী দেখতে পায়নি, ফলে খুন্তিটা উঠল চৌধুরী সাহেবের দিকে। চৌধুরী সাহেব ওর এই সাহসে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। অনীল সেন ততক্ষণে নেমে দৌড় লাগাচ্ছেন।
সেলিমকে দৌড়াতে দেখা প্রতিদিনের ঘটনা। আজ সঙ্গে অনীল সেনও। বাজারে আজ দৌড় কম্পিটিশনও হবে নাকি! দেখাদেখি আরো কয়েকজন দৌড়াতে শুরু করল।
তরুণ জননেতা এবং দুবার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নির্বাচনে ফেল করা আনোয়ার হোসেন পপি লাইব্রেরির সামনে বসে দেশ-সমাজ উদ্ধার করে। কয়েকজন উটকো ধরনের শ্রোতা জোরে জোরে ওর সঙ্গে গলা মেলায়। আর অপেক্ষা করে কখন চায়ের সঙ্গে টোস্ট বিস্কুট আসবে। আনোয়ার চালাক হয়ে গেছে। বলে দেয়া আছে, তার বক্তব্য শেষ হওয়ার আগে যেন চা না আসে। একদিন শুরুতেই চলে এসেছিল। পরে ওকে বক্তব্য দিতে হয়েছে শ্রোতা ছাড়াই। সে দৌড়াতে থাকা মানুষদের দেখে বলল, ‘এই যে দেখুন কোথায় যাচ্ছে দেশ?’
সবাই দেখে। সেলিম-অনীল সেন দৌড়াচ্ছেন। পেছনে পেছনে আরো কয়েজকজন।
বিরক্ত হয়ে একজন বলল, ‘দেশ আবার কোথায় যাচ্ছে? যাচ্ছে তো সেলিম আর অনীল বাবু। কোনো ধান্দার পেছনে…’
‘এই তো…আপনাদের ছোট চোখ। ছোট করে দেখছেন। চোখ বড় করুন। এর মধ্যেই দেশকে পাবেন।’
সবাই চোখ বড় করে। না, দেশকে দেখা যায় না।
আনোয়ার হতাশ হয়। এই মানুষগুলোকে এত বাণী দিয়েও দেশ জিনিসটাই বোঝানো যাচ্ছে না। এই যে মানুষের দৌড়, এই যে ছুটে চলা, এটাই সমস্যা ………………………………
‘আনিস সাহেবের আয়না’ পাওয়া যাবে বইমেলায় পার্ল পাবলিকেশনের প্যাভিলিয়নে।
![আনিস সাহেবের আয়না 2 Anis Saheber Ayna](https://mustafamamun.com/wp-content/uploads/2022/02/Anis-Saheber-Ayna-400x270.jpg)