পরিচিত এক ভদ্রলোক দেখা হলেই বলতেন, ‘ফ্যাক্টরিতে এসো একদিন। ’
ফ্যাক্টরি মানে সোয়েটার তৈরির কারখানা। কারখানা ভ্রমণের জন্য খুব আদর্শ জায়গা নয়। ব্যস্ত, পরে একদিন… যেভাবে সবাই অপছন্দের প্রস্তাব কাটিয়ে যায় সেভাবে কাটিয়ে যাচ্ছিলাম।
বিজ্ঞাপনএকদিন ভাগ্য অপ্রসন্ন হলো। তাঁর সঙ্গে ঠিক ফ্যাক্টরির সামনে দেখা। এরপর আর এড়ানো যায় না। চললাম ভেতরে।
আর যেতে যেতে একবার মনে হলো, নরকের পথ কি এমনই হবে? সরু সিঁড়ি, গাদাগাদি করে রাখা কাঁচামাল। আলো জ্বলছে কিন্তু আলোর ভেতরেও যেন ঘোর অন্ধকার।
তিনি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখালেন। নিজের অর্জন পরিচিতদের কাছে প্রকাশ করতে মানুষের চেষ্টার ত্রুটি থাকে না। যা নয় তা বলেন। উদ্যোক্তা হতে গিয়ে কী কী কৃতিত্ব দেখালেন, কোন সরকারি কর্মকর্তা প্রশংসা করে বলেছেন—আপনি একেবারে ফাটিয়ে দিচ্ছেন। বিদেশি বায়ারদের প্রসঙ্গও এলো। চীনা না কোরিয়ানরা নাকি তাঁর সোয়েটার গায়ে দিয়ে বলছে, এটা পরলে তো স্যুটের চেয়েও স্মার্ট দেখায়। কিন্তু আমার মাথায় তখন অদ্ভুত এক দুশ্চিন্তা ভর করেছে। বারবার মনে হচ্ছে, হঠাৎ চারদিক অন্ধকার হয়ে যাবে। এবং আমি এই অন্ধকূপে চিরদিনের জন্য আটকা পড়ে যাব।
আটকে থাকিনি; বরং চা-নাশতা খেয়ে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু ওরা যারা চা-নাশতা খেতে যায় না, যারা ঘাম বিক্রি করতে যায়—তাদের আটকে রাখার জন্যই সব ফন্দি করা হয়। এমনই যে এই সরু সিঁড়িতেও তালা ঝুলে। বাইরে আগুন জ্বলছে, তবু আহাজারি করেও কাজ হয় না। কোথায় যেন পড়লাম, দরজা লাগিয়ে রাখা হয়, না হলে নাকি এই সুযোগে মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি হয়ে যাবে। অতএব মূল্যহীন মানুষরা মরুক। মূল্যবান সামগ্রী টিকে থাকুক। আর একভাবে দেখলে তো এগুলোরই দাম বেশি। লাখ-কোটির ঘরে এসব জিনিসের দাম। মৃত শ্রমিকরা হাজারের ঘর পেরোতে পারেনি এই অর্থনৈতিক উন্নতির যুগেও।
এই মূল্যহীনদের জন্য আমরা কিছু করতে পারি না। তাই মূল্য আরো কমে। আগে লাশ মিলত। এখন মেলে হাড়গোড়। এরপর মিলবে ছাই। এবং তারপর হয়তো তা-ও মিলবে না। হয়তো গোনা-গুনতির ঝামেলায়ও কেউ যাবে না। যেমন পশুপাখির মৃতদেহ আমরা গুনে রাখি না।
তা কিছুই যখন করতে পারি না, তখন বরং দু-একটা গল্প শুনি। একটা নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করছিল একজন শ্রমিক। একসময় দুর্ভাগ্যবশত পা ফসকে নিচে পড়ে গেল। তাতে তার কিছু হলো না, কিন্তু তার শরীরের নিচে চাপা পড়ে একজন পথচলতি মানুষ মারা গেলেন। মামলা আদালত পর্যন্ত গড়াল। বিচারক অনেক শুনেটুনে শ্রমিককে খালাস দিয়ে বললেন, ‘এটা ছিল দুর্ঘটনা। ’
মৃত মানুষের ছেলে সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে বসল। তার দাবি, তার বাবার মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ তাহলে কিভাবে হবে? বিচারক বললেন, ‘তাহলে এক কাজ করা যাক। মৃত মানুষের ছেলে এবার ওপরে উঠুক। সে ওখান থেকে নিচে পড়বে; এবং তখন সেই শ্রমিক নিচে দাঁড়িয়ে থাকবে। মৃতের ছেলের চেষ্টা করতে হবে এই শ্রমিকের ওপর পড়ার। ’
মৃতের ছেলে এবার লাফ দিয়ে বলল, ‘এটা কী ধরনের বিচার। আমি যে ওনার ওপর পড়তে পারব এর গ্যারান্টি কী?’
‘কোনো গ্যারান্টি নেই। আর এ জন্যই এটা দুর্ঘটনা। যে ঘটনা একভাবে দুইবার ঘটে না বা ঘটানো যায় না সেটাই হলো দুর্ঘটনা। ’
আর এই জায়গায়ই আমাদের ঘটনাগুলো দুর্ঘটনা নয় মোটেও। একইভাবে ঘটে। সেই আগুন লাগা। সেই শ্রমিকদের আটকে রাখা। সেই প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা। এগুলো তাই দুর্ঘটনা নয়। ঘটনা। ঘটেছে। ঘটছে। ঘটবে।
দুঃখভরে পরের ঘটনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আরেকটা গল্প শুনি। কাঠের কলের ম্যানেজার সেলিম সাহেব কাটাকাটি তদারক করছিলেন। অভিজ্ঞ মানুষমাত্রই জানেন, এই মানুষগুলোর কানে সব সময় একটা পেনসিল লাগানো থাকে, তা দিয়ে কোথায় কাটতে হবে তার চিহ্ন এঁকে দেন। তো দুর্ঘটনাক্রমে এক দিন কারেন্ট চলে গেল। অন্ধকারে নিরাপদ জায়গায় যেতে গিয়ে সেলিম সাহেব চলে গেলেন বিপজ্জনক জায়গায়। কাটার জন্য কাঠ যেখানে স্থাপন করা হয় সেখানে ঢুকে গেল তাঁর কান। সে সময়ই কারেন্ট আসায় মেশিনটা চালু হয়ে গিয়েছিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে, প্রথম ধাক্কায়ই কানটা কেটে ছিটকে পড়ল। তাড়াতাড়ি সবাই মিলে সেলিম সাহেবকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে চলল। কানটাও কুড়িয়ে নেওয়া হলো। যদি লাগানো যায়!
কিন্তু সেলিম সাহেব বেঁকে বসলেন। এই কান তাঁর নয়। বললেন, ‘আমার কান হলে পেনসিল লাগানো থাকত। ৩০ বছর ধরে এই কানে পেনসিল লাগানো থাকে। আলাদা হতেই পারে না। ’
বিচ্ছিন্ন পেনসিলটাও কেউ একজন উদ্ধার করে এনেছিল। এবারও সেলিম সাহেব অনড়। বললেন, ‘গাধার দল, দেখছ না পেনসিলটা কানে ঠিক বসছে না। এটা আমার কান হতেই পারে না!’
ডাক্তার বললেন, ‘পেনসিলও আসলে কানটা আপনার কি না চিনতে পারছে না। তাই বসতে চাইছে না। কানটা জায়গামতো লাগাই। তারপর দেখবেন পেনসিলও বসবে। ’
আমাদের মৃতরা সেলিম সাহেবের মতো ভাগ্যবান নয় যে নিজের হাড়গোড়-ছাইয়ের এই মেলানোর পরীক্ষা নিজেরা করতে পারবেন। তাঁরা গেছেন। রয়ে গেছেন যাঁরা, তাঁরা হাড়গোড় পেতে নানা জায়গায় ধরনা দিচ্ছেন।
ভাবলে শরীর অবশ হয়ে যায়। মন-মাথা কিছুই আর কাজ করে না। এখন জানা যাচ্ছে এবং যাবে, এরা ঠিকমতো কারাখানাবিধি মানত না। শিশুশ্রমিকদের দিয়ে কাজ করাত। ট্যাক্স দেয় না। অনেক অবৈধ সম্পদ করেছে। বিদেশে টাকা পাচারের ঘটনাও হয়তো বেরোবে। বেরোতেই থাকবে।
মাঝে মাঝে মনে হয়, মালিকদের এসব অপকর্ম জানানোর জন্যই শ্রমিকদের এই বলিদান। এমনিতে তো ওদের কথা কেউ শুনবে না। মরে গেলে তখন বরং আওয়াজটা কিছুদিন সবাই একটু শোনে। এটাই বোধ হয় এই হতভাগাদের একমাত্র প্রাপ্তি। মৃত্যুতে তৈরি সামান্য কিছু মূল্য। শোষকদের লোক-দেখানো হলেও জেলেটেলে নেওয়া হয়।
আর যাঁরা কর্তৃপক্ষ, তাঁদের এই সময়ের তৎপরতা অতুলনীয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এই মালিকদের যাবতীয় অপকর্ম তাঁরা বের করে ফেলেন। প্রশ্ন আসে তাহলে আগে তাঁরা কী করেন?
গল্পটা শুনি। একদল শ্রমিক গেল কারখানা দপ্তরের বড় কর্তার কাছে। অভিযোগ নিয়ে।
তিনি মোবাইলে বাল্যবন্ধুকে একটা মজার কৌতুক ফরোয়ার্ড করছিলেন। এমন গুরুতর সময়ে তুচ্ছ দাবিদাওয়ায় বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কী চাই?’
‘আমাদের কারখানার অবস্থা খুব খারাপ। ’
‘কারখানার অবস্থা খারাপ হলে তোমাদের কী? সেটা তো মালিকের ব্যাপার। বেচারার ব্যবসা লাটে উঠবে। আহা রে ভদ্রলোক, কত ট্যাক্স দেয়। জিডিপিতে কত অবদান। ’
‘কিন্তু একটা ব্যবস্থা না নিলে আগুন লাগতে পারে যেকোনো দিন। কেমিক্যাল-দাহ্য জিনিস যত্রতত্র পড়ে থাকে। ’
‘বলছ কী? আগুন লাগলে তো করিম সাহেব বসে যাবেন। কী মাই ডিয়ার মানুষ। জিডিপিতে কী অবদান…’
‘কিন্তু আমরা তো মরতে পারি। বাইরে থেকে সিঁড়ি তালা মারা থাকে। ’
‘না হলে তো তোমরা ফাঁকি মারো। আরো তালা লাগানো উচিত। আর মনে রেখো, এসব কথা শুনলে অভিমান করে তিনি কারখানা বন্ধ করে দিতে পারেন। তাহলে তিনি না খেয়ে থাকবেন না; কিন্তু তোমরা পথে বসবে। যাও যাও। আহা রে করিম সাহেব! জিডিপিতে কী অবদান…’
অতএব, শ্রমিকরা ফিরে গেল। কিছুদিন পর আগুন ধরল। পুড়ে মরল। সেই কর্তা মারাত্মক তৎপরতা দেখালেন। টিভির সামনে হাজির হয়ে তাত্ক্ষণিকভাবে জানিয়ে দিলেন, এখানে কী কী অনিয়ম ছিল। আগুন লাগার মতো দাহ্য পদার্থ যে জমা ছিল সেটাও বিস্তারিতভাবে ঘোষণা করলেন। তাঁর এই তৎপরতায় ধন্য ধন্য উঠল। তিন সদস্যের যে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি হলো, তিনি হলেন তার প্রধান। অনেক তারিখ ফেল করে শেষে যে রিপোর্ট দিলেন, তাতে অবশ্য সেসব অনিয়মের কথা থাকল না; বরং কয়েকজন মারা গেলেও বাকিরা যে মরেনি, সেটা রক্ষায় মালিক কর্তৃৃপক্ষের কৃতিত্ব বিশেষভাবে উল্লেখ করা হলো। পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন এই রিপোর্ট পেলে ঝামেলা করবে, তিনি জানেন। যুক্তি তৈরি আছে। বলবেন, প্রাথমিকভাবে তাঁকে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছিল। অধিকতর ও গভীর তদন্ত শেষে সঠিক তথ্য বের করতে পেরে তৃপ্ত বোধ করছেন।
পত্রিকা-টেলিভিশন অবশ্য ঝামেলা করল না। মাঝখানে এত কিছু ঘটে গেছে। করোনার নতুন ঢেউ, রাজনীতির উত্তেজনা, ক্রিকেটের জয় মিলিয়ে রিপোর্টটার দিকে আর কারো মনোযোগ ছিল না।
এটা বানানো গল্প। কোনো গল্প কি অন্য রকম হয়? আমি কিন্তু শুনিনি।
লেখক : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক
প্রথম প্রকাশঃ কালের কন্ঠ
প্রকাশ কালঃ ১৫ জুলাই, ২০২১
লিঙ্কঃ এই হতভাগাদের নতুন-পুরনো গল্প