মোস্তফা মামুন, জোহানেসবার্গ থেকে (ফিফা বিশ্বকাপ ২০১০ নিয়ে লেখা)
বিশ্বকাপে কাকাকে দেখা যাবে যেমন দেখা যায় ব্রাজিলিয়ান নাম্বার টেনকে। মেসিকে দেখা যাবে আর্জেন্টিনার বোকা-রিভার বিভক্তিরেখা বুটের তলা দিয়ে মুছে দিতে। রোনালদো জানেন, তাঁর জন্য বরাদ্দ কয়েকটি দৃশ্য। কাজেই সেগুলোতেই মাত করে দিয়ে মানুষকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হবে। ফিফার মিডিয়া গাইডে তাঁদের তিনজনের হোটেলের যে চিহ্নগুলো দেওয়া আছে, সেগুলো দিয়ে চমৎকার একটা ত্রিভুজ আঁকা যায়। বাহুগুলো হবে অসমান। এখনকার পারফরম্যান্স দিয়ে তিনজনকে তিনটি রেখায় ফেলা যায়, হয়তো সবচেয়ে বড়টা এখন মেসির, তারপর রোনালদোর, তারপর কাকার। কিন্তু বিশ্বকাপের পর…
এ বিশ্বকাপটা হবে আমার। দুনিয়াকে দেখিয়ে দেব, আমি কতটা কী করতে পারি! বলছেন লিওনেল মেসি। আমি এখন ধীরে ধীরে জায়গামতো যাচ্ছি। বিশ্বকাপে আপনারা সত্যিকারের কাকাকে দেখবেন। এবার বক্তার নাম কাকা। বাংলাদেশের জন্য এ দুজনই যথেষ্ট। কারণ, এক-আধটু উপেক্ষাযোগ্য তফাত বাদ দিলে বাংলাদেশে বিশ্বকাপ মানে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা এবং সেই সূত্রে মেসি-কাকা। বিশ্বকাপ বাঙালির চার বছরের জমানো ফুটবল আবেগের বিপ্লবী বহিঃপ্রকাশ এবং উপচে পড়া আবেগ যেহেতু, কাজেই কিছু অসঙ্গতি স্বাভাবিক। সেই অসঙ্গতিতে মাঝেমধ্যে কাটা পড়ে যান জিদান কিংবা বাজ্জিও। তাঁদের দলের প্রতি যেহেতু তেমন আগ্রহ নেই, কাজেই তাঁরা কতটা কী করবেন না করবেন, তা নিয়ে মাথাব্যথা থাকে সামান্য। পরে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা গেলে মনে পড়ে, আরে এ তো দারুণ খেলে!
১৯৯৮ বিশ্বকাপে জিদান বাংলাদেশে বড় খেলোয়াড় হয়েছিলেন বিশ্বকাপ শেষে, যখন ব্রাজিলকে তিনি হারালেন এবং যতদিনে আর্জেন্টিনার সমর্থকরা তাদের হারের দুঃখ ভুলতে পেরেছে। এবারও তেমন একজন আছেন, এবং বেচারা বড় অসুবিধায়। জিদান-বাজ্জিওদের দল তো আমরা পছন্দ করি না, করি শিরোপার তালিকায় থাকলে, ফলে কোনো একটা সময় মনোযোগ তাঁরা কাড়েনই। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সেই সুবিধাটুকু নেই। দল পর্তুগাল। গতবার সেমিফাইনালে উঠলেও এবার অত দূর যাওয়ার সম্ভাবনা সামান্য। প্রথম রাউন্ডে ব্রাজিল-আইভরি কোস্টের খাঁড়া সামনে। পা ফসকানোর যথেষ্ট আশঙ্কা। তবু ধরা যাক, সেটা থেকে রক্ষা পেলেন। তাতেও নিস্তার নেই। বড়জোর আগুন থেকে কড়াইয়ে উঠবেন, ওখানে তাদের সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ এ বিশ্বকাপের সেরা দল স্পেন। কাজেই খুব ঝামেলায় আছেন রোনালদো। আর সে জন্যই বোধ হয় অনেক ঘেটেও এমন একটা কথা পাচ্ছি না, যেটা ঠিক রোনালদোর চরিত্রের সঙ্গে যায়। রোনালদো কথাবার্তায় আত্দম্ভরী ধরনের। সমর্থকদের কাছে যেটা আত্দবিশ্বাস, বিরুদ্ধবাদীদের জন্য অহংকার। ২০০৮-০৯ মৌসুমটা অসাধারণ কাটানোর পর তাঁর বর্ষসেরা হওয়াটা একদম নিশ্চিত। সেই সময় হঠাৎ ঝামেলা পাকানো শুরু করলেন মেসি, বছরের শেষদিকে অসাধারণ সব সলো গোল, দুনিয়াছাড়া সব ড্রিবলিং। স্প্যানিশ মিডিয়ায় রব উঠল, ‘রোনালদো নয়, মেসিকে দাও গোল্ডেন বল।’ শুনে রোনালদো বললেন, ‘সোনার বল আসলে তিনজন লোকের প্রাপ্য। এক, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, দুই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, তিন, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।’ এই হলেন রোনালদো এবং সেই তিনি বিশ্বকাপকে ‘আমার হবে’ ‘দেখিয়ে দেব’ জাতীয় কোনো কথা বলছেন না। বলবেন কী করে! নিজেও জানেন, ব্যক্তিগত দক্ষতায় যতই হাততালি মিলুক, শেষ পর্যন্ত ফুটবল দলীয় খেলা এবং সেখানে দল না জিতলে কিছু হয় না। এখানে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো সঙ্গে রুনি নেই, রিয়ালের মতো কাকা নেই, ছিলেন মন্দের ভালো ন্যানি, ইনজুরির নির্মম খৰ এসে কেটে নিয়ে গেল তাঁকেও। একা থেকে রোনালদো আরো একা হয়ে গেছেন। ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের বাগাড়ম্বরের জায়গায় এখানে তাঁর গলায় ফুটবলের দলীয় শক্তি আর সংহতির জয়গান! রোনালদো নিজে যা ধরে নিচ্ছেন বা মেনে নিচ্ছেন, সেটা মানতে আপনার-আমার খুব আপত্তি থাকার কথা নয়। এ বিশ্বকাপের রোনালদো হতে যাচ্ছেন মঞ্চের সেই অভিনেতা, যার এক-দুটি সিন থাকে এবং সেগুলো দেখে দর্শকরা বলে, ছেলেটা নায়কের রোল পেলে…।
এ লেখা যেখানে বসে লিখছি, সেখান থেকে মাত্র চার-পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে রোনালদোর হোটেল ভ্যালি লজ। এবং তা থেকে কাকার হোটেলের দূরত্ব আরো কম। চাইলে রাতে দুজন একসঙ্গে বসে কফি খেতে খেতে ‘সতীর্থ যখন শত্রু’ গোছের কোনো পর্তুগিজ গান শুনতেও পারেন। এবং চাইলে মেসিও সেখানে যোগ দিতে পারবেন। এবং দেবেন না। প্রথমত, দুজনের সঙ্গে ক্লাব বা কোনো সূত্রেই মেসির এমন কোনো বন্ধুত্বের কথা কেউ শোনেনি। রোনালদোর সঙ্গে গত দুই বছরের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই সূত্রে কিছু অপ্রিয় কথা চালাচালি হয়েছে। তা হলেও মেসি অভদ্র নন, আমন্ত্রণ পেলে আসতেন হয়তো, কিন্তু ম্যারাডোনা আসতে দিলে তো! ম্যারাডোনা প্রিটোরিয়ার হাই পারফরম্যান্স সেন্টারকে প্রায় কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বানিয়ে যাবতীয় জাগতিকতা থেকে দূরে রেখেছেন মেসিদের। এতটাই যে আর্জেন্টাইন সাংবাদিকরাও কাছে ঘেঁষতে পারছেন না। খুব চেনা কেউ হলে হয়তো ম্যারাডোনা কাছে ডাকেন। তখন তাঁর পাশে বসেই দেখতে হয়, ও আচ্ছা, মেসি এখানে আছেন! কিন্তু ম্যারাডোনার এ ‘সুবোধ বালক’ সুযোগ পেলেই এমন কামান দাগছেন কেন? বিশ্বসেরা হওয়ার পরও যিনি বার্সেলোনা টিমমেটদের সব কৃতিত্ব দিতে যান, কেউ প্রশংসা করলে পাড়ার ভদ্র ছেলের মতো সলজ্জ মাথা নিচু করে বলেন, ‘সবই তো আপনাদের দোয়া’, সেই তাঁর মুখে এমন আগুন কেন? আর্জেন্টাইন ফুটবলকর্তা হোনাস রদ্রিগেজ অবশ্য অবাক নন, ‘আসলে মেসির বিষয়টা কি জানো তো, সে আর্জেন্টিনায় তারকা নয়। আর্জেন্টিনায় তারকা হতে হলে আগে ওখানে কিছু করতে হয়। ধরো, বোকা জুনিয়রস বা রিভার প্লেটের হয়ে কিছু জেতাতে হয়। কিন্তু মেসির সে রকম কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকায় যা হয় ওখানে তার কোনো নির্দিষ্ট সমর্থকগোষ্ঠী নেই। ফলে তাকে বাঁচাতে কেউ আসে না। তাই মেসিকে আর্জেন্টিনার হয়ে নিজের ঢোল নিজেকে পেটাতে হয়।’ বেশ বিস্তারিত ব্যাখ্যা, যুক্তি আছে, কিন্তু যুক্তির পেছনে পাল্টা যুক্তিও আছে। তাহলে ম্যারাডোনা এবার এত সমালোচনার মুখে কেন? ‘তোমরা বাইরের বিশ্ব হয়তো মনে করো যে আর্জেন্টিনায় ম্যারাডোনার বিরোধী কেউ নেই। সেটা ভুল। আমাদের ওখানে বোকা-রিভার লড়াই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার চেয়েও ভয়ংকর। ম্যারাডোনা শুধু বোকায় খেলেইনি, সে ঘোষিত বোকা সমর্থক এবং এ জন্যই রিভারের লোকজন তার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। আর ডিয়েগো নিজেও তো নিজের সমালোচনা ডেকে আনে।’ আর কাকা! সেখানে আবার উল্টো সমীকরণ।
কিছুদিন আগে রিয়াল মাদ্রিদের পত্রিকা কাকার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিল, তিনি নাকি জাতীয় দলের জন্য খেলা জমিয়ে রাখতে তাঁর সেরাটা ক্লাবকে দিচ্ছেন না। মিথ্যা অভিযোগ। ২০০৭ সালে কাকা যে গোল্ডেন বল জিতেছিলেন, সেটা তো এসি মিলানকে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতিয়ে, সেখানে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে। কাকার তো এমন কিছু সমালোচনাও হচ্ছে না, বরং প্র্যাকটিস ম্যাচগুলো সব তাঁর স্বমূর্তিতে ফেরার পূর্বাভাস দিচ্ছে। তাহলে! ব্রাজিলের একজন সাংবাদিক ব্যাখ্যাটা দিচ্ছেন এ রকম, ‘আসলে বিষয়টা কি জানো, ব্রাজিলে যারা ইউরোপে খেলতে যায়, তাদের ব্রাজিলিয়ান সম্পত্তি মনে করা হয় তখনই, যখন তারা বিশ্বকাপে দলকে জেতাতে পারে। কাকা ২০০২ সালে দলে ছিল বটে, কিন্তু একটা ম্যাচে কিছুক্ষণ খেলা ছাড়া তার আর তো কোনো অবদান ছিল না। এখন এবার বিশ্বকাপই তার জন্য দেখানোর ক্ষেত্র। মনে রেখো, রোনালদিনহো গত বিশ্বকাপে ওটা পারেনি বলে ব্রাজিলে তার সেই সম্মান আর নেই। দেশের মানুষের কাছে সে কতটা সম্মান পাবে না-পাবে, সেটা ঠিক করে দেয় এ কয়েকটি ম্যাচ। চাপটা তাই অনেক বেশি।’ কাকা কি তাহলে নিজেকে জাগানোর জন্য এসব বলছেন? ‘কাকা ছেলেটা কিন্তু অন্য রকম। ভড়ং নেই। ভনিতা নেই। সে যা বিশ্বাস করে, তা-ই বলে। হয়তো বিশ্বাস করে সত্যিই সে তার ফর্মে ফিরছে। এবং ফর্মে ফিরলে…।’ ভদ্রলোক হাসেন। তৃপ্তির হাসি। ব্রাজিল সমর্থকরাও হাসতে পারেন। কাকা যা বলেন, তা বিশ্বাস করেই বলেন। আর বলছেন, তিনি ফিরছেন…ইনজুরি জয় করে, ক্লাবের চাপ পেছনে ফেলে হয়ে উঠতে চলেছেন ব্রাজিলিয়ান নাম্বার টেনের ঐতিহ্য সংরক্ষণের সার্থক প্রতিনিধি। তাহলে! বিশ্বকাপে কাকাকে দেখা যাবে যেমন দেখা যায় ব্রাজিলিয়ান নাম্বার টেনকে। মেসিকে দেখা যাবে আর্জেন্টিনার বোকা-রিভার বিভক্তিরেখা বুটের তলা দিয়ে মুছে দিতে। রোনালদো জানেন, তাঁর জন্য বরাদ্দ কয়েকটি দৃশ্য। কাজেই সেগুলোতেই মাত করে দিয়ে মানুষকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হবে। ফিফার মিডিয়া গাইডে তাঁদের তিনজনের হোটেলের যে চিহ্নগুলো দেওয়া আছে, সেগুলো দিয়ে চমৎকার একটা ত্রিভুজ আঁকা যায়। বাহুগুলো হবে অসমান। এখনকার পারফরম্যান্স দিয়ে তিনজনকে তিনটি রেখায় ফেলা যায়, হয়তো সবচেয়ে বড়টা এখন মেসির, তারপর রোনালদোর, তারপর কাকার। কিন্তু বিশ্বকাপের পর…। উল্টেও যেতে পারে। কারণ, এটা ক্লাব নয়, জাতীয় দলের খেলা। এখানে আবার বাকি দুজনের মতো দুর্নাম নেই কাকার, এখন পর্যন্ত তিনি যতটাই ক্লাবের খেলোয়াড়, ততটাই জাতীয় দলের খেলোয়াড় এবং বিশ্বকাপ জাতীয় দলেরই খেলা। ত্রিরত্নের এ কল্পিত ত্রিভুজের রেখাগুলোর মাপ বিশ্বকাপ চলবে আর বদলাবে। শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় রেখাটা যে কার, সে হিসাব মেলানো শুরু করুন। মিলতেই হবে এমন কোনো কথা নেই, মেলাটা আগে জানা যায় না বলেই তো অঙ্ক। আর অঙ্কটা ঠিকমতো মেলে না বলেই না এর সৌন্দর্য।
প্রথম প্রকাশঃ কালের কন্ঠ
প্রকাশ কালঃ ১০ জুন, ২০১০