বিদেশি খেলোয়াড়দের খুশি করার একটা চিরন্তন উপায় আছে। গিয়ে গলায় গদগদ ভাব নিয়ে বলা যে, বাংলাদেশে তুমি খুব জনপ্রিয়। তাঁদের কেউ কেউ এমন যে নিজের দেশে জনপ্রিয় শুনলেই হার্টফেল করার দশা হয়, সেখানে যদি শোনেন বহু দূরের এক দেশের মানুষ তাঁকে চেনে এবং ভালোবাসে তাহলে মুগ্ধ হতে বাধ্য। সেই মুগ্ধতায় কাজ হয় কিছু।
যেমন হলো অ্যারন ফিঞ্চের ক্ষেত্রে। বাড়িয়ে বলা বা তোষামোদি করা- এ রকমটাও কেউ ভাবে না। যে বা যারা এক-আধবার বাংলাদেশ ঘুরে গেছে তারা জানে এ এমন এক দেশ, এমন পাগুলে ক্রিকেট-হাওয়া এখানে বয়ে চলে যে সেই হাওয়ায় তার পক্ষেও জনপ্রিয় জাতীয় কিছু হওয়া সম্ভব।
কিন্তু সত্যি ঘটনা হলো ফিঞ্চ বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয় কেউ নন।
ক্লার্ক-জনসন কিংবা হালের স্মিথের মতো তারকাদ্যুতিও তাঁর নেই। কিন্তু বিশ্বকাপ যদি হয় বিচার্য তাহলে এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার সেরা পারফরমার তিনি। প্রথম ম্যাচের পর এক সপ্তাহ বসে থাকা এবং আবার বাংলাদেশ ম্যাচ পণ্ড হয়ে যাওয়াতে অস্ট্রেলিয়ানদের যে দুই সপ্তাহ সময় তাতে রোমন্থন করার মতো কীর্তি শুধু ফিঞ্চের সেঞ্চুরিই। আর সেই সেঞ্চুরিটা করেছিলেন কখন, যখন ৭০ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ওরা ধুঁকছে।
কেউ কেউ তাতে অস্ট্রেলিয়ার ১৯৯২ বিশ্বকাপের ভাগ্য দেখতে শুরু করেছিলেন। নিজের মাঠে দারুণ ফেভারিট হিসেবে শুরু করে শুরুতেই যে গোলমাল হয় সেটা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সেবার ফিঞ্চ ছিলেন না, এবার ছিলেন। আর তাই ১২৮ বলে ১৩৫ রানের ইনিংসে ধস সামলে শেষ পর্যন্ত ৩৪২ রানের পাহাড়। ইংল্যান্ড তাতে চাপা।
ফিঞ্চ কীর্তিটার প্রসঙ্গে খুব উচ্ছ্বসিত নন, ‘দেখুন, আমার কাজই হচ্ছে রান করা। প্রতিদিনই সেই কাজটা থাকে কিন্তু সবাই তো আর সব দিন পারবে না। যেদিন যে পারে সেদিন তাঁর কাজ হলো যত বেশি সম্ভব বড় স্কোর করা। এভাবেই খেলা হয়। এখানে এক দিন আমি করেছি, আরেক দিন করবে আরেকজন। ক্রিকেট খেলাটা দলগত হলেও মজাটা হলো একেক জন একেক দিন কাজটা করবে। এভাবে মিলে মিলেই এটা দলীয় খেলা। সবাই সব দিন যদি ভালো করত তাহলে তো আর এটা ১১ জনের খেলা হতো না। এক-দুজনেই হয়ে যেত।’
খুব গুছিয়ে দেওয়া ব্যাখ্যা কিন্তু এসব ব্যাখ্যার জন্য ফিঞ্চের চেয়ে ঢের আদর্শ লোক দুনিয়াতে ছড়িয়ে। ফিঞ্চ নিয়ে কৌতূহল বা বলা ভালো প্রশ্ন হলো, তাঁর মতো ব্যাটসম্যানরা ক্রিকেট ব্যাটকে গদা বানিয়ে তুমুল মেরে ব্যাটিংয়ের শুদ্ধ সৌন্দর্যটাই কেড়ে নিচ্ছেন কি না? টি-টোয়েন্টির সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের ইনিংস তাঁর, সেটা একটা কৃতিত্ব। কিন্তু তাঁর ব্যাট করার ধরন, শরীরের আকার-ভাষা ঠিক ক্রিকেটারসুলভ নয় যেন! আর অনেকের মতে সেই মারগুলোও সম্ভব হয় ভারী আধুনিক ব্যাটের কারণে! কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ফিঞ্চ হাসতে হাসতে বললেন, ‘আচ্ছা তাহলে আমি বা আমরা জোরে মারতে পারি ব্যাটের জন্য?’
‘না শুধু ব্যাট নয়। সঙ্গে শক্তিও আছে।’
‘এমন ব্যাট দিয়ে তো সবাই খেলে। সবাই পারে?’
‘তা পারে না কিন্তু অমন শক্তিও তো হয়তো সবার নেই।’
‘এগুলো একদম বাজে কথা। ভালো ব্যাট হলেই জোরে মারা যায় না, বেশি শক্তি থাকলেও হয় না। তাই যদি হতো তাহলে আমি আমার চেয়ে অনেক শক্তিশালী খেলোয়াড়দের কথা জানি। তারা তো পারে না। আবার আমার চেয়ে দুর্বল ব্যাটসম্যানরা কখনো কখনো আমার চেয়েও জোরে মারতে পারে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে ব্যাট বা শক্তি নয়, জোরে মারার জন্য টেকনিকই আসল। আপনাকে বল বুঝতে হবে, কোনটা মারবেন, কোনটা ছাড়বেন। রিফ্লেক্স ভালো হতে হবে। আর সঙ্গে বিশ্বাসটা থাকতে হবে।’
যুক্তিগুলো শুনতে শুনতে মনে হলো কথাটা তো ঠিক। জোর-ব্যাট এর সঙ্গে ওদের মতো করে টেকনিক হার্ডহিটারদেরও আছে। আছে বলে কেউ কেউ ফিঞ্চ হন, সবাই নন। কিন্তু খেলাটার সৌন্দর্য, ব্যাটিংয়ের শিল্প? ফিঞ্চের উত্তর আছে এখানেও, ‘খেলাটা একেক সময় একেক রকম হয়। আর সব কিছু বদলাচ্ছে। প্রযুক্তি আসছে। ক্রিকেট আর ব্যাটিং বদলাবে না?’
বদলাচ্ছে! সেই বদলে বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে ২০ ওভারের ক্রিকেটে দুই শ রানও মনে হয় খুবই সম্ভব। ওয়ানডেতে সম্ভব তিন শ রানও। এবং ফিঞ্চকে যেহেতু এসব কীর্তি করার একজন সম্ভাব্য প্রার্থী ধরা হয়, তিনি কী মনে করেন? ‘এগুলো সময় ধরে বলা যায় না। হয়তো হবে। কিন্তু আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে আমি বলব টি-টোয়েন্টির দুই শটা তুলনামূলক বেশি সম্ভব। ওয়ানডের তিন শটা অনেক কঠিন। রোহিত যদিও অনেক দূর গিয়েছিল কিন্তু কাজটা খুব কঠিন। দেখা যাক।’
দেখা যাক! ফিঞ্চরা যেভাবে আসছেন এবং যেমন তাণ্ডব চালাচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে সবই সম্ভব। ক্রিকেটে বা ব্যাটিংয়ে অসম্ভব বলে কোনো ব্যাপার বোধ হয় থাকল না!
প্রথম প্রকাশঃ কালের কন্ঠ, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
লিংকঃ ব্যাট বা শক্তি নয়, টেকনিকটাই আসল