ক্যাডেট কলেজে শুরুতেই একটা ক্যাডেট নাম ঠিক করা হয়, পুরো নাম থেকে একটা অংশ বাছাই করে, সেই হিসেবে আমার নাম ঠিক হলো মামুন। আগে পাঠানো চিঠিতে সেটা জানানো হয়েছিল বলে নির্দিষ্ট দিনে মামুন নাম ধারণ করেই হাজির হলাম। অভ্যর্থনা জানাতে একটা দল প্রস্তুত ছিল, তারা জিজ্ঞেস করল নাম কী?
এসব গুরুগম্ভীর জায়গায় পুরো নাম বলাই নিয়ম মনে করে নামটা বললাম। একজন কাগজপত্র দেখে বলল, ‘ও আচ্ছা, মোস্তফা এসেছে।
আমি ক্ষীণকণ্ঠে বলার চেষ্টা করলাম, ‘আমার নামটা সম্ভবত মামুন।’
স্যারদের কেউ একজন ধমকে উঠলেন, ‘তুমি কি আমাদের চেয়ে বেশি জানো? চুপ করে থাকো।’
চুপ করে থাকলাম। মোস্তফা নামের নেমপ্লেট লেগে গেল বুকে।
আমি মামুন থেকে মোস্তফা হয়ে বসে বসে ভাবছি ভুলটা হয়তো আমাদেরই হয়েছিল। চিঠিটা হয়তো ঠিকমতো দেখিনি বা হয়তো এখানে নিয়ম এমন যে চিঠিতে একটা নাম দেওয়া হয়, পরে নামটা বদলে ফেলা হয়। ক্যাডেট কলেজ সম্পর্কে তখন ধারণাটা হলো, এখানে যা যা হয় সব কিছু ঠিক, আমরা যা জানি বা বুঝি সেগুলো সব ভুল। এর মধ্যেই হঠাৎ শুনি হইচই।
সিনিয়র ক্যাডেটদের একজন চিৎকার করে বলছে, ‘সর্বনাশ হয়েছে। একজন ভুয়া চলে এসেছে মনে হয়।’
সবাই সব কাজ দিয়ে ওর দিকে মনোযোগী। ক্যাডেট কলেজের এই কঠোর বেষ্টনীর মধ্যে একজন ভুয়ার চলে আসা এত বিস্ময়কর ঘটনা যে সবাই স্তব্ধ।
সিনিয়র ক্যাডেটটি বলল, ‘এই যে মোস্তফা এসেছে।
অথচ এখন একজন মোস্তফা নাম নিয়ে চলে গেছে।’
সঙ্গে সঙ্গেই সবার চোখ ফিরল আমাদের দিকে। কয়েক সেকেন্ডেই ভুয়া হিসেবে শনাক্ত হয়ে গেলাম আমি। যে স্যার চুপ করতে বলেছিলেন তিনি ধমকে উঠে বললেন, ‘তোমার নাম কি মোস্তফা?’
‘জি স্যার।’
স্যার বিদ্রূপের হেসে বললেন, ‘আসো আসো কিছুক্ষণের মধ্যেই আসল মোস্তফা আর নকল মোস্তফা বের হয়ে যাবে। তারপর…’
আমিই নকল মোস্তফা হিসেবে সাব্যস্ত হলাম। আমার নাম মোস্তফা মামুন, সেই হিসেবে নাম দেওয়া হয়েছিল মামুন। আরেকজন ছিল গোলাম মোস্তফা, মোস্তফা নামটা ছিল ওর। কিন্তু আমার নামের প্রথম অংশ শুনেই অভ্যর্থনাকারীদের দল আমাকেই মোস্তফা বানিয়ে দিয়েছিল। এই ভুল দিয়ে যার শুরু, তার ক্যাডেট জীবনটা খুব আনন্দের হওয়ার কথা নয়। হয়ওনি। কিভাবে কিভাবে যেন যেকোনো গোলমালে আমার নাম জড়িয়ে পড়ত। স্যাররা এসেই খুঁজতেন ‘মামুন কোথায়? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।’ আমাদের একজন ভাইস প্রিন্সিপাল স্যার ছিলেন, যিনি আমাকে সামনে পেলেই বেত উঁচিয়ে বলতেন, ‘তোমাকে আমি বেতিয়ে-বেতিয়ে, পিটিয়ে-পিটিয়ে লাল বানিয়ে ছাড়ব।’
অথচ সেই আমি, আজ ২০-২২ বছর পর যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন মনে হয় শেষ পর্যন্ত জীবনের সেরা সময়গুলো ক্যাডেট কলেজেই কাটিয়েছি। এর চেয়ে আনন্দের জীবন আর হয় না। নিজেকে তৈরির জন্য, বুদ্ধি-চিন্তার বিকাশের জন্য কী আদর্শ একটা জায়গা!
কিভাবে? আরেকটা গল্প বলি। ক্লাস সেভেনে আমাদের পাক্ষিক পরীক্ষা হবে, স্যার এলেন ক্লাসে। আমরা অপেক্ষা করছি প্রশ্নের। স্যার বললেন, ‘আজ তোমরা কবিতা আবৃত্তি করবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতাটা আবৃত্তি করবে সবাই।’
একজন মনে করিয়ে দিল, ‘স্যার আজ তো পরীক্ষা হওয়ার কথা।’
স্যার গম্ভীর গলায় বললেন, ‘এটাই পরীক্ষা। তুমিই প্রথম আবৃত্তি করবে।’
সে আবৃত্তি করল খুব দরদ দিয়ে। স্যার বললেন, ‘তুমি পেলে ১২।’ নম্বরটা পঁচিশে।
এভাবে কবিতা আবৃত্তি করে কেউ পেল ১২, কেউ ১৫, কেউ ১৬, একজন পেয়ে গেল পুরো ২৫।
সেদিন এ নিয়ে খুব হাসাহাসি করলাম; কিন্তু যেকোনো সময় আবৃত্তি দিয়ে পরীক্ষা হয়ে যেতে পারে বলে সবার মধ্যে আবৃত্তির একটা চর্চা তৈরি হয়ে গেল। বাংলা অভিধান ঘেঁটে শব্দ খোঁজাটাও হতে পারে কোনো একটা পরীক্ষার বিষয়বস্তু, কাজেই অভিধানেও মন দিলাম সবাই। আমাদের বয়সের অন্য স্কুলের ছাত্ররা যখন প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে আমরা তখন সঞ্চিতা, সঞ্চয়িতা, সংসদ বাংলা অভিধান নিয়ে ব্যস্ত। সংস্কৃতি আর চিন্তায় সমৃদ্ধ একজন বাংলা স্যার সেই শৈশবেই আমাদের অতটা এগিয়ে দিয়েছিলেন।
অনেকেই এখন জানে ক্যাডেট কলেজ চলে প্রিফেক্টোরিয়াল সিস্টেমে। মানে, ক্যাডেটরাই ক্যাডেটদের পরিচালনা করবে। সবচেয়ে সিনিয়র, মানে ক্লাস টুয়েলভের ছাত্রদের মধ্য থেকেই প্রিফেক্ট বা লিডার বানানো হয় এবং তাদেরই দায়িত্ব থাকে বাকি ক্যাডেটদের নিয়ন্ত্রণের। শৃঙ্খলা ঠিক রাখা, নিয়মমতো সব চালানোর দায়িত্ব তাদের ওপর। বাইরের পরিবেশ থেকে কেউ ভাবতেই পারবে না ইন্টারমিডিয়েটের একজন কিশোরের হাতে কী অসীম ক্ষমতা। এখানে মূল যে ব্যাপারটা ঘটে সেটা হলো এই লিডারদের জব্দ করা এবং এই আইন অমান্য করার ক্ষেত্রে জন্ম নেওয়া সৃজনশীলতা। আমরা ক্লাস এইটে থাকার সময় একদিন হুলস্থুল কারবার। বাথরুমে লম্বা লাইন। সকালে পিটির পর অল্প কিছু সময়, সেই সময়ে সবাইকে গোসল করে নাশতার জন্য তৈরি হতে হয়। তো সেদিনও পিটি শেষে সবাই দৌড়ে বাথরুমে গিয়েছিল, গিয়ে দেখে সব বাথরুমেরই দরজা লাগানো আর ভেতরে কল ছাড়া। প্রত্যেকেই শুরুতে ভেবেছিল কেউ হয়তো তার আগে এসে ঢুকেছে, মিনিট পাঁচ-সাতেক পর বেরোবে। কিন্তু কেউ আর বের হয় না। ১০-১৫ মিনিট হয়ে আধাঘণ্টা হওয়ার পর সবার মনে হলো, কোথাও ঝামেলা আছে কোনো। হাউস লিডার ছুটে এলেন, তাঁর নির্দেশে একজন ওপর দিয়ে উঠে দেখে কোনো বাথরুমে কেউ নেই; যদিও ভেতর থেকে দরজা বন্ধ, কলও ছাড়া। তদন্ত করা হলো, অপরাধীও বের হয়ে গেল বিকেলের মধ্যে। জানা গেল, সে কাজটা করেছে শুধু হাউস লিডারকে একটু বিব্রত করতে। এভাবে বাথরুম আটকে রাখলে কেউ আর গোসল করতে পারবে না, ক্লাসে যেতে পুরো হাউসের দেরি হবে এবং সেই সূত্রে হাউস লিডার অক্ষম-অথর্ব বলে প্রমাণিত হবেন! হাউস লিডার সব শুনে বললেন, ‘ঠিক আছে সেটা না হয় প্রমাণ করা হলো; কিন্তু কাজটা তুমি করলে কিভাবে?’
অপরাধীটি করে দেখাল। মুগ্ধ হওয়ার মতোই ব্যাপার। প্রতিটি বাথরুমে ঢুকে ছিটকিনি ভেতর থেকে লাগিয়ে তারপর জানালা দিয়ে দড়ি বেয়ে সে বেরিয়ে গেছে চমৎকারভাবে।
হাউস লিডার বললেন, ‘আমি খুশি হয়েছি, যদিও শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য কঠোর শাস্তি তোমার পাওনা; কিন্তু তোমার এই বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তার জন্য এবারের মতো ক্ষমা করে দিলাম। ক্যাডেটরা দুষ্টুমি করবে, এর মধ্যে স্পেশালিটি না থাকলে হয় নাকি!’
এমন আরো হাজারো গল্প প্রতিদিন তৈরি হয়। এই দুটি বললাম এ জন্য যে এর একটি থেকে বোঝা যাচ্ছে, কেউ চাইলে ক্যাডেট কলেজের সুযোগ আর সুশিক্ষা নিয়ে অনেক সমৃদ্ধ হতে পারে। আবার যারা নিয়ম মানতে চায় না তাদেরও নিয়ম ভাঙতে গিয়ে, বুদ্ধিমানদের ফাঁকি দিতে গিয়ে আরো বেশি বুদ্ধিমান হতে হয়।
আপাত উচ্ছৃৃঙ্খলতার মধ্যেও একটা বুদ্ধির চর্চা মিশে থাকে, শেষ পর্যন্ত যা তাকে সমৃদ্ধই করে। একই বয়সের অনেক ছেলে বা মেয়ে একসঙ্গে থাকা আনন্দময় ব্যাপার হতে বাধ্য, ফাঁকে দলবদ্ধ হওয়ার শিক্ষাটা তৈরি হয়। আত্মত্যাগের বিষয়টাও আসে। আমাদের সময় একটা ব্যাচের পুরো ৫০ জন কলেজ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল তাদের একজন বন্ধুকে আউট হওয়া থেকে বাঁচাতে।
সামরিক বাহিনীর কঠোরতায় তৈরি, সেই আইনকানুনের বাড়াবাড়ি কচি বয়সের মনস্তত্ত্বের ওপর ক্ষেত্রবিশেষে কুপ্রভাবও ফেলে। তা ছাড়া পরিচালনার ক্ষেত্রে অর্থোডক্স চিন্তাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয় বলে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশও রুদ্ধ হয় কোথাও কোথাও।
আবার নিজেদের মধ্যে অতিরিক্ত কেন্দ্রীভূত থাকার ফলে ক্যাডেটদের কারো কারো মধ্যে উচ্চম্মন্যতার জন্ম হয়, যা বাইরে আসার পর বাকি সমাজের সঙ্গে এক ধরনের মানসিক সংঘাত তৈরি করে। কিন্তু এসব সমস্যা তুচ্ছ হয়ে যায় যখন এই দৃশ্যটা ভাবি যে ওখানে সামান্য একটা ডাইনিং হলের বেয়ারা কিংবা অফিস পিয়নের ছেলে ক্যাডেট হয়ে জুনিয়রদের ওপর দাপট দেখায়, আর সবার মতো তারও সমান অধিকার। বাবা কে, কোন পরিবার থেকে এসেছে-এসব প্রশ্ন হারিয়ে গিয়ে স্রেফ ক্যাডেট পরিচয়ে এক পোশাক পরে, একই রকম খাবার খেয়ে যে সমতা তৈরি হয়, সেই সমতাই তো আসলে সমাজেও আমরা চাই। ক্যাডেট কলেজ সেই হিসেবে এক আদর্শ সমাজের ছবি, যেখানে সবাই এক, একাকার এবং সমান সুযোগের দাবিদার।
কিশোরদের জন্য এর চেয়ে আনন্দময় ভুবন পাওয়া যেতে পারে দুটি মাত্র জায়গায়। স্বপ্নে এবং স্বর্গে। বাস্তবে জায়গা কিন্তু একটাই। জীবনকে রঙিন করার সব রং নিয়ে সেজে থাকা ক্যাডেট কলেজ।
প্রথম প্রকাশঃ কালের কন্ঠ, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৪
লিংকঃ ক্যাডেট জীবনের গল্প