মোস্তফা মামুন, মেলবোর্ন থেকে ::
কয়েক দিনে কত কী ঘটে গেল! ঝড়ের মতো কাণ্ড! এখন ঝড়টাকে ঝোড়ো হাওয়ায় নামিয়ে সামাল দেওয়ার দায়িত্বটা তোমার।
আমরা সবাই জানি আল আমিন তোমার প্রিয় খেলোয়াড়দের একজন। বিশ্বকাপ দলে নির্দিষ্ট করে তাঁকে চেয়েছিলে, সেটা এ জন্য যে মনে হয়েছিল ওর সুইংটা খুব কাজে লাগবে। শ্রীলঙ্কান দলে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান বেশি বলে তাদের বিপক্ষে ওকে খেলানোরও একটা পরিকল্পনা ছিল হয়তো।সেই পরিকল্পনাটা মার খেয়ে গেল বলেই শুধু নয়, দলের মধ্য থেকে এভাবে একজনের ছিটকে পড়া বাকিদের মনোবলে ধাক্কা দেবে স্বাভাবিক। কিন্তু তোমার সমস্যাটা এর মধ্যেও বেশি। ওর বিদায়ে খারাপ লাগছে, তবু মন শক্ত করে নামতে হচ্ছে মেরামতের কাজে। নিজের হতাশাটা প্রকাশ করা যাচ্ছে না পাছে বাকিদের মধ্যেও সেই হতাশা ছেয়ে যায়।
সংবাদ সম্মেলনে তোমাকে বলতে হয়, ‘আল আমিন এখন অতীত। এই ঘটনা নিয়ে ভাবতে চাই না আমরা।’ তারপর যখন বললে, ‘যে অপরাধ করেছে সে তার শাস্তি পেয়েছে’- তখন চেহারায় স্বাভাবিকতা থাকলেও ভেতরের রক্তক্ষরণটা বোঝা যায়। নিজের রক্তক্ষরণটা যেভাবে প্রলেপে ঢেকে রাখছ পুরো দলের ক্ষরণটাও যেন এভাবে ঢেকে থাকে।বের হতে দেওয়া যাবে না। সুযোগই নেই কোনো।
ব্রিসবেনের সোফিটেল হোটেলেই সম্ভবত আড্ডায় বলছিলে, ‘আমাদের কপালটা দেখেন শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ম্যাচটা দিয়ে দিল মেলবোর্নে!’ প্রথমটায় ধরতে একটু সমস্যা হয়েছিল। মেলবোর্নে ম্যাচ হওয়া আমাদের মতো দলের জন্য বিরাট প্রাপ্তি, খেলোয়াড়দের এই জীবনে আবার সুযোগ আসে কি না কে জানে, তবু তুমি চিন্তিত। ব্যাখ্যাটা শোনার পর অবশ্য মনটা ভরে গেল।তুমি বললে, ‘এখানে শ্রীলঙ্কান অনেক বেশি। ওদের অনেক লোক আসবে মাঠে।’ ভেবে ভালো লাগল যে দর্শক-কন্ডিশন এসব নিয়ে আমাদের অধিনায়কের নিজের মতো করে গবেষণা আছে। দর্শকের কথা সব খেলাতেই ভাবা হয়, ওদের জন্যই তো সব আয়োজন। কিন্তু দর্শকের নাম করে কাউকে কাউকে সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে ক্রিকেট ক্রমশই অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে নিজেকে। মেলবোর্নে শ্রীলঙ্কান বেশি, তাই শ্রীলঙ্কার খেলা এখানে, মানলাম। সঙ্গে এটাও মানলাম যে নিউজিল্যান্ডের নেলসন স্কটিশ শহর বলে সেখানে স্কটল্যান্ডের খেলা। কিন্তু মজাটা দেখো ওই দুই দেশকে সুবিধা দিতে গিয়ে দুবারই বলি হতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। তাও না হয় মানলাম। তাহলে বাংলাদেশের একটা ম্যাচ সিডনিতে নয় কেন? সেখানেই সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি থাকে, তাদের কথা কেন ভাবা হবে না! অন্যরা কেউ ভাববে না, ভাবতে বাধ্য করতে হয়। সেই কাজটা যাঁদের করার কথা কেন যেন মনে হয় সেদিকে তাঁদের কোনো আগ্রহ নেই। আমাদের কর্তাদের ভ্রমণবিলাস দেখে কে একজন সেদিন বলছিল, ‘এমন যদি হতো বাংলাদেশের ৬টা ম্যাচ ১২টা শহরে হবে, একেকটা ইনিংস একেকটা শহরে তবু আমাদের কর্তারা রাজি হয়ে যেতেন। ১২টা শহর ঘোরা যাবে যে!’ রসিকতা কিন্তু এই রসিকতাগুলো এমনি এমনি তৈরি হয়নি। সূচিতে যে আমাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে সেই প্রতিবাদে কেউ নেই, আছেন ঘুরে বেড়ানোতে। এই অস্ট্রেলিয়ায় খুঁজে পেতে বোর্ড কর্তাদের বের করতে হয় আমাদের! আমার ধারণা, কোন দেশের বোর্ড কর্তারা সবচেয়ে বেশি এসেছেন বিশ্বকাপে- এই প্রতিযোগিতা হলে কাপটা আমরাই নিয়ে যেতাম! যা-ই হোক, এই যখন বোর্ড আর অভিভাবকদের অবস্থা তখন তোমার বা তোমাদের কাজটা অনেক বেড়ে যায়।
আফগানিস্তান ম্যাচের পর থেকে বারবার তুমি যে বিষয়টাকে গুরুত্ব দিচ্ছ সেটা হলো তাসকিন এবং রুবেলের গতি। ওরা ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটারের মতো গতিতে বল করেছে। তুমি তাদের নাকি বলে দিয়েছিলে, বল করবে আর বোর্ডের দিকে গতি দেখবে। ওরা কথা রেখেছে। সত্যি বললে দুজনের গতি আর সঙ্গে তোমার নিয়ন্ত্রণক্ষমতার মেলবন্ধনে আফগানিস্তান পথ হারিয়ে ফেলে শুরুতেই। কিন্তু কাল যেটা ভালো লাগল সেটা হলো সংবাদ সম্মেলনে শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ আফসোসের সুরে বললেন, ‘আমাদের দলে অত গতির বোলার নেই যারা ১৪৫-১৫০ গতিতে বল করবে। কাজেই যা আছে তা নিয়েই আমাদের চেষ্টা করতে হবে।’ দারুণ ব্যাপার না! একটা সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলের যা নেই বাংলাদেশের তা আছে। গতি হয়তো সবচেয়ে বড় ব্যাপার না, তবু শেষ পর্যন্ত বিরাট ব্যাপার। পেস বোলারদের সবার আগে পেস থাকতে হয়। সেটা আমাদের পেসারদের আছে এবং যদিও মেলবোর্ন ওয়াকা-গ্যাবার মতো গতিমঞ্চ নয়, তবু বাউন্স মিলিয়ে জোরে বলের মূল্য এখানেও কম কিছু নয়। কিন্তু গতির তোড়ে চলবে না, সঙ্গে লাগবে তোমার জায়গামতো বল ফেলে খাবি খাওয়ানোর সেই গুণ। স্পিনটা এই ম্যাচে খুব বড় করে দেখতে চাই না, কারণ ওরা স্পিনে খুব অভ্যস্ত দল। তবু সাকিব আছে, আর সবচেয়ে ভালো করেই তুমি জানো তাঁর জন্য উইকেট কন্ডিশন কিছু লাগে না। বল ঘুরুক না ঘুরুক সাকিব ঠিক বিপক্ষের মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে। এমনিতে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতার দূরত্ব ঢাকা-মেলবোর্ন দূরত্বের মতোই, ওদের দলে সর্বকালের সেরাদের সারিতে গিয়ে ঢোকার মতো দুজন ব্যাটসম্যান আছে। আছে মালিঙ্গার মতো ‘বিচিত্র’ বোলার, কিন্তু সুবিধার দিক হলো দলটা ঠিক ফর্মে নেই। একটা ম্যাচ লজ্জাজনকভাবে হেরে এবং আফগানিস্তানকে কোনোভাবে হারিয়ে ওদের মনোবলটা তলানিতে থাকার কথা। ম্যাথুজকেও খুব আত্মবিশ্বাসী দেখাল না। একটা দল যখন ফর্মের চূড়ায় থাকে না তখনই পিছিয়ে থাকা শক্তির দলের পক্ষে সম্ভব নিজেদের সেরা খেলাটা খেলে ম্যাচটা বের করে নেওয়া।
চারদিকে এমন একটা হাওয়া তৈরি হয়েছে যে এটা ফিফটি-ফিফটি ম্যাচ। বিষয়টা মোটেও সে রকম নয়। তবু শ্রীলঙ্কা আমাদের চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু এ রকম একটা ফরটি-সিক্সটি ম্যাচ তো বের করে নিতে হবে।
না, আশার চাপে পিষ্ট করতে চাচ্ছি না। সম্ভাবনার খুলে থাকা জানালাটা দেখাচ্ছি মাত্র। স্কটল্যান্ড বাদ দিলে বাকি যে তিন দল তারা কেউ আমাদের জন্য দরজা খুলে রাখবে না। ভরসা জানালাটাই। শ্রীলঙ্কার জানালাটাই এর মধ্যে সবচেয়ে বড় দেখাচ্ছে!
প্রথম প্রকাশঃ কালের কন্ঠ, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
লিংকঃ প্রিয় মাশরাফি