ঈশ্বর নাকি মানুষের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হন। তাই যদি হয় তাহলে বোধ হয় এই গ্রহে ম্যারাডোনার মধ্য দিয়েই তিনি প্রকাশিত হয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি। কে জানে, এ জন্যই অত তাড়াতাড়ি তাঁকে ডেকে নিয়ে গেলেন কি না! ৬০ বছর এমন কিছু বয়স নয়। ফুটবল ছেড়ে দিয়েছিলেন যদিও, তবু পৃথিবীকে রঙিন করার রসদ তো ফুরিয়ে যায়নি।
আরো উত্তেজনা দিতেন, আরো তর্ক বাধাতেন, আরো খ্যাপাটে কাণ্ড। এবং এসবে যে পৃথিবী বিরক্ত না হয়ে প্রশ্রয় দিত, তার কারণ সেই অশেষ কৃতজ্ঞতা। ফুটবলের ভেতর ভরে শিল্প আর সুন্দরের যে বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছিলেন, এই গ্রহ এর তুল্য কিছু আগে-পরে দেখেনি।
অনেক বছর আগে এক ক্রিকেটার হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘আমরা আর কত দিন বাঁচব।৩৫-৩৬। খুব ভাগ্যবানরা হয়তো ৪০।’
‘কেন? কেন? জীবন-মৃত্যুর এই গ্যারান্টি কী করে খেলোয়াড়রা পায়?’
‘খেলোয়াড়ের জীবন মানে যত দিন আপনার খেলা আছে। খেলা নেই তো সব শেষ।কেউ গোনে না। কেউ ফিরে চায় না। যারা খেলোয়াড়ি জীবনে পেছনে ছুটত ওদের কাছে ধরনা দিতে হয়।’
তখনো টেলিভিশন এভাবে আসেনি এই অঞ্চলে। বাণিজ্যের হাজারও রাস্তা খুলে যায়নি বলে সাবেক হওয়া মানেই অবহেলার জীবন।কথাটা তাই যুক্তিগ্রাহ্য। খুব তর্ক করিনি।
সেদিনই অফিসে ফিরে বিদেশি কিছু এজেন্সি কপি দেখছিলাম। চোখ পড়ল ম্যারাডোনার একটা খবরে। কাস্ত্রোর সঙ্গে কিউবাতে বসে পার্টি
করছেন। রাষ্ট্রপ্রধানতুল্য মর্যাদা। খেলা ছাড়ার কত বছর পর! আজও সেই খেলোয়াড়ি দিনগুলোর মতোই মিডিয়া অনুসরণ করে চলে। আজও তাঁর পথচলায় মানুষ নিজেকে ঠিক খুঁজে পায়। একবার ভাবলাম, এই পর্যবেক্ষণটা ক্রিকেটারকে বলি। পরে মনে হলো, দূর উত্তর তো জানাই। বলবেন, ম্যারাডোনা তো একজনই। এ রকম কেউ আসেওনি। আসবেও না।
এ রকম কেউ আসেনি। আসবে না। আর তাই যাওয়াটা বুকের ভেতর স্বজন হারানোর হাহাকার হয়ে বাজে। তিনি বেঁচে থাকলেও আসত-যেত না এমন অনেকেও যে শোকে ডুবে, এর কারণ মানুষটা বেঁচে থাকলে হঠাৎ মাঝে মাঝে অনিশ্চিত কিছু করে বসত। বিনোদন মিলত। আর বিনোদনের মইয়ে চড়ে পুরনো দিনেও ফেরা যেত। যেখানে সিন্দুকে কী সব মণি-মুক্তা থরে থরে সাজানো। ম্যারাডোনা তাই আমাদের অতীতের সঙ্গে যোগাযোগের সেতু। স্মৃতির সঙ্গে বর্তমানের মেলানোর মানুষ। আর তাই পাশের বাড়িরও মানুষ যেন। পরশু রাত থেকে পরিচিত-অপরিচিতের যা ফেসবুক স্ট্যাটাস বা আলোচনা দেখছি সব ম্যারাডোনার সঙ্গে নিজের পুরনো সময়েরও গল্প। টাইম মেশিন সায়েন্স ফিকশন রাইটারদের কল্পনা। ম্যারাডোনার মাধ্যমে বাস্তব। একীভূত পৃথিবী, গ্লোবাল ভিলেজ রাষ্ট্রচিন্তকদের তাত্ত্বিক ধারণা। ম্যারাডোনা তাঁর রূপায়ণকারী।
সাদামাটা সরলরেখার জীবন হলে শোকেসে বেশি করে থাকা যায়। হৃদয়ে থাকতে ঐশ্বরিক সামর্থ্যের সঙ্গে মানবিক ভ্রান্তি লাগে। সোনার সঙ্গে প্রয়োজনীয় খাদের মতো সেটুকুতে মিলে আরো বেশি মানুষের। শুধু বিশ্বকাপগুলো দেখুন। একটারও স্বাভাবিক পরিণতি নেই। ১৯৮২-তে লাল কার্ড, ১৯৮৬-তে চূড়ান্ত জাদুময়তা, ১৯৯০-তে কান্না, ১৯৯৪-তে মাদক কেলেঙ্কারি। উত্থান-পতনের এমন পিরামিড। ভালো খেলা-খারাপ খেলা, গোল করা-না করা এইতো ফুটবলারদের ক্ষেত্রে অনুমিত ধারণা। ফুটবলের সঙ্গে সেই প্রতিষ্ঠিত ধারণাগুলোকেও পা দিয়ে খেলেছেন তিনি। পা দিয়ে ঠেলেছেন সভ্যতার আরো বহু রকম সংজ্ঞাকে। তাঁর পর্যায়ের মানুষেরা নিজের খেলার দূত হয়ে যাবেন, মনে যা-ই থাকুক প্রতিষ্ঠানের প্রতি একটা লৌকিক শ্রদ্ধা দেখাবেন, এটাই পৃথিবীর নিয়ম। তিনি ধার ধারেননি। ফিফা যখন ভোটে জেতার পরও তাঁর সঙ্গে পেলেকে আরেকটি ট্রফি দেয় তখন উত্তেজিত হয়ে অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসেন। স্যুট পরে সুবেশ ভদ্রলোক হয়ে খেলা দেখার বদলে সাধারণের সঙ্গে মিশে সাধারণ সমর্থকের মতো হৈচৈ করেন। ফিফা বা প্রতিষ্ঠান তাতে বিব্রত হয় আবার মানতে বাধ্যও হয়। ওদিকে এর মধ্যে মানুষ আবার খুঁজে পায় তার একজনকে, যে ওর মনের কথাগুলো বলছে। আমাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার যে মানসিকতা সেটাই তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়ে তাঁকে আরেক দফা নিজের করেছে। ম্যারাডোনা যখন বেড়ে উঠছেন লাতিন আমেরিকায় তখন বিপ্লবের রোমান্টিকতা। সেই সময় দুটি উপায়ে মানুষের ভাগ্য বদলানো যেত। এক, ফুটবল। খেলে প্রচুর রোজগার করে অর্থনীতির উন্নতির স্তরে। দ্বিতীয়, সফল সমাজবিপ্লব। তাতে সামগ্রিকভাবে সব মানুষকে নিয়ে জীবন বদলানোর সুযোগ। ম্যারাডোনা প্রথম উপায়ে অনেক আগেই সফল। এবং সাধারণত নিজের ভাগ্য বদলে গেলে কেউ অন্যদের নিয়ে ভাবে না। ফুটবলোত্তর ম্যারাডোনা দ্বিতীয়টা যাঁরা করতে চেয়েছিলেন তাঁদের সঙ্গী হয়ে, ফিদেল কাস্ত্রোদের বন্ধু হয়ে মানুষকে জানালেন, তিনি সাধারণেরই বন্ধু।
শেষ পর্যন্ত তাঁকে দেখলাম। ২০১০ বিশ্বকাপ কভার করতে গিয়ে। মনে আছে, জোহানেসবার্গ থেকে কেপ টাউনের সেই মাঠে যেতে বিস্তর হেপা হয়েছিল। স্থানীয় বাঙালির গাড়ি নিতে হলো। বাইরে আবার দীর্ঘ অপেক্ষা। এরপর ঢুকে গ্যালারি থেকে আণুবীক্ষণিক দর্শন। তত দিনে বয়স থাবা বসিয়েছে। দাড়িতে বিপ্লবীর বদলে এখন মধ্যবয়সী প্রাজ্ঞতার ছাপ। মেদের কারণে অফুটবলীয় অবয়ব। কিন্তু একটা টোকা, অনুশীলনের ছোট্ট একটা পায়ের টোকায় এমন আলাদা হয়ে গেলেন যে সেই সন্ধ্যায় মনেই হলো না বাস্তবে আছি। অনুশীলন শেষে টুকটাক দৌড়াদৌড়ি চলছে। সঙ্গে হাসি-তামাশা। তিনিও তাতে শামিল। প্রতিটি পদক্ষেপ এমন অনুসরণ করলাম যে ১০ বছর পরও পুরো একটা গ্রাফিক ডেসক্রিপশন সম্ভব। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, আমার না হয় প্রথম দেখা। অনেক সমুদ্র আর নদীর দূরত্বের দেশের মানুষ। কিন্তু যারা ওকে রোজ দেখে, তারাও কেন এত আবেগী। বলছিলাম আর্জেন্টাইন সাংবাদিককুলের কথা। ওদের চোখও ‘ডিয়েগো’র দিকে। মেসি, বর্তমানের মুকুট পরে থাকা মেসি সেখানে দ্বিতীয়।
এরপর দুটো সংবাদ সম্মেলন। একদিন ঢুকলেন একটা বিরাট চুরুট খেতে খেতে। সংবাদ সম্মেলনের মতো অনুষ্ঠানস্থলে মানায় না। কিন্তু মানানো-বেমানানোর ব্যাকরণ দিয়ে ওকে গণ্ডিবদ্ধ করা যায় না। পরেরটা আর্জেন্টিনা ৪-০ গোলে হেরে বিদায়ের পর। ঢুকে প্রথম যা বললেন, সেটা ট্রান্সলেটরটা ঠিক কাজ করছিল না বলে বুঝলাম না। কিন্তু হাসি দেখলাম স্প্যানিশভাষীদের মুখে। পরে জানা গেল, কথাটা ছিল এ রকম, তাঁর নাকি মনে হচ্ছে এখন মোহাম্মদ আলী মুখে একটা ঘুষি বসিয়ে দিয়েছেন। আরো অনেক কথার পর সংবাদ সম্মেলন শেষে বেরোনোর পথে দেখি কোনো একজন সাংবাদিক পাশে পাশে যাচ্ছে। বোঝা যায়, পরিচিত কেউ নয়। ম্যারাডোনাকে কাছে পাওয়ার আবেগে ছবি বা সেরকম কোনো দাবি করবে। ৪-০ হার, বিশ্বকাপ শেষ, এই সময় এমন আবদার। এর কপালে আবার মোহাম্মদ আলীর ঘুষি ফিরে আসে কি না সেই আশঙ্কা নিয়ে তাকিয়ে দেখি, আরে ম্যারাডোনা তো দিব্যি দাঁড়িয়ে গেছেন ওর জন্য পোজ দিতে।
এই সামান্য অভিজ্ঞতাই ম্যারাডোনাময়তা সঠিকভাবে চিত্রিত করে। কখন কী করবেন না করবেন কেবল তিনিই জানেন। ওর মামলা লড়া এক আইনজীবী একবার নিজের অভিজ্ঞতার কথা আদালতকে বলেছিলেন এভাবে, ‘ইয়োর ওনার, আমার মক্কেলকে আমিই ঠিক বুঝতে পারি না। সকালে যা বলেন বিকেলে দেখি অন্য কথা।’ পরে সেই আইনজীবী একটা লেখা লিখেছিলেন অভিজ্ঞতা থেকে। বলছিলেন, ‘তাঁর মনে হয়েছে মাথায় ফুটবলটা এমনভাবে ঢুকে আছে যে মস্তিষ্কে অন্য বোধের জায়গা খুব একটা নেই। ফলে কী করেন না করেন সেটা ধরা বাদ দিয়ে দেন একসময়।’ আর তাই বোধ হয় এয়ারগানের গুলি খেয়েও সাংবাদিক সমাজ বিগড়ে যায় না। চেনা পৃথিবী আবেগ নিয়ে পাশে রয়ে যায়। দূরের ফুটবলাবিষ্ট দুনিয়া এর মধ্যে খুঁজে পায় পূর্ণতার রং।
আর তাই তিনি ফুটবল ছেড়ে দিয়েও যেমন বিপুলভাবে ছিলেন, তেমনি পৃথিবী ছেড়ে গেলেও থেকে যাবেন অমরত্ব নিয়ে। ‘তোমার কীর্তির চেয়ে মহৎ’ হয়ে ওঠা চরিত্রই ‘মরনে দান করে গেলে মৃত্যুহীন প্রাণ’ জাতীয় ছন্দগুলোকে সত্য করে থেকে যাবে যুগের পর যুগ। শরীর গেল। অবিনশ্বর কীর্তি তো রইল। তিনি গেলেন। তাঁর পূজারিরা তো রইলাম।
তিনি ঈশ্বরের ডাকে ঈশ্বরের কাছে। কে জানে ঈশ্বরও হয়তো এক পাক ওর সঙ্গে খেলে নিচ্ছেন কি না। এবং সেখানেও নয়-ছয় হলে কিন্তু ছাড় দেবেন না। ঠিকই গর্জে উঠবেন।
ওদিকে পেলে বলছেন, তিনি স্বর্গে গিয়ে তাঁর সঙ্গে খেলতে চান। এপারে থাকা আরো অনেকেরই হয়তো এমন স্বপ্ন। পরশুর পর থেকে পৃথিবী আর স্বর্গের একটা যোগাযোগের সেতুও দেখছি তৈরি হয়ে গেল!
প্রথম প্রকাশঃ কালের কন্ঠ, ২৭ নভেম্বর, ২০২০
লিংকঃ এখন স্বর্গের সঙ্গে যোগাযোগের সেতু তিনি